Sunday 22 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যেসব কারণে ইসরায়েলকে যুদ্ধ সহায়তা দিচ্ছে ট্রাম্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২২ জুন ২০২৫ ২৩:১৪ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৫ ২৩:৩২

যেসব কারণে ইসরায়েলকে যুদ্ধ সহায়তা দিচ্ছে ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ সহায়তা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে, সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ সহায়তা ফের প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া পদক্ষেপ ও বিপুল অর্থ ব্যয়ে পাঠানো সামরিক সহায়তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নিজ ঘাড়ে রয়েছে জাতীয় ঋণের বিশাল দায়ভার।

রোববার (২২ জুন) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন- যুক্তরাষ্ট্র সফলভাবে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এরই মধ্যে ইসরায়েল নিশ্চিত করে যে, এই হামলাগুলো তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। মার্কিন অস্ত্রভাণ্ডার থেকে বিপুল পরিমাণ গাইডেড বোমা, ড্রোন ও মিসাইল ব্যবহার করা হচ্ছে এই অভিযানে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক

ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের-ই প্রতিফলন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই তাকে স্বীকৃতি দেয়। এর পর থেকে প্রায় ৩১০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি ১০ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুযায়ী প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে।

তবে গবেষকদের মতে এই সহায়তা শুধুমাত্র পারস্পরিক সম্পর্কের সৌহার্দ্যের কারণে নয়। বরং, ইসরায়েলকে একটি ‘অসম্ভব ধ্বংসযোগ্য মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে মার্কিন কৌশলের অংশ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার হেইগ একবার বলেছিলেন, ‘ইসরায়েল হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ, যা কখনো ডোবে না, যেখানে কোনো মার্কিন সৈনিকও মোতায়েন নেই।’

একই কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। তিনি ১৯৮৬ সালে বলেছিলেন, ‘যদি ইসরায়েল না থাকত, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য এরকম একটি দেশ তৈরি করতে হতো।’

ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের কৌশল

বিশ্বব্যাপী শক্তি প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। অঞ্চলটি শুধু তেল-গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ নয়, বরং এর তিনটি চোকপয়েন্ট- হরমুজ প্রণালী, সুয়েজ খাল ও বাব আল-মানদাব বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, এই অঞ্চলে চীন, রাশিয়া কিংবা ইরান প্রভাব বিস্তার করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্বে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই, ইসরায়েলকে ব্যবহার করে তারা অঞ্চলটির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মাইকেল হাডসন বলেন, ‘ইসরায়েল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রবৃদ্ধির ধারক।’ তার মতে, এটি কেবল সামরিক সহায়তা নয়, একটি নব্য উপনিবেশিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম।

জাতীয় ঋণের মাঝেও অস্ত্র সহায়তা

এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ প্রায় ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা দেশের মোট জিডিপির তুলনায় অনেক বেশি। মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ ভর্তুকির অভাব দেশটিকে অর্থনৈতিক দিক থেকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অথচ, এর মাঝেই ইসরায়েলকে দেওয়া অতিরিক্ত ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত) মার্কিন জনগণের একটি বড় অংশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পূর্বনির্ধারিত বার্ষিক সহায়তা এবং ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত অনুমোদিত তহবিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, বরং একটি মৌলিক নীতিগত প্রশ্ন— কেন যুক্তরাষ্ট্র একটি যুদ্ধরত দেশকে বিপুল সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে? যখন নিজ দেশেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো খাতে সংকট চলছে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই একমুখী সহায়তা দীর্ঘমেয়াদে তাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান লেহি আইন ১৯৭৬ সালের সিমিংটন সংশোধনী (Leahy Law ও Symington Amendment of 1976) অনুযায়ী, কোনো দেশ যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকে, তবে তাকে সামরিক সহায়তা দেওয়া আইনত নিষিদ্ধ। বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা, সাংবাদিক ও কংগ্রেস সদস্য দাবি করেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র এই আইনগুলো কার্যকর করেনি। বরং, তারা বারবার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এসব আইনকে এড়িয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল সহায়তা কেবল রাজনৈতিক পছন্দ নয়, এটি এক দীর্ঘস্থায়ী ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ, যা অর্থনৈতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করে পরিচালিত হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, বিশ্ব যখন বহুতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অতিমাত্রার সামরিক সহায়তা তার ক্ষমতা ধরে কতদিন রাখতে পারে।

সারাবাংলা/এনজে/পিটিএম

ইরান ইসরায়েল ট্রাম্প যুদ্ধ সহায়তা