Wednesday 13 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চলছে লুটের মহোৎসব
সাদাপাথরের ঝরনা এখন ধু ধু বালুচর

জুলফিকার তাজুল, সিলেট
১৩ আগস্ট ২০২৫ ০৮:০১ | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৫ ১২:০৬

এখানেই এককাল বিছানো ছিল সাদা পাথর, এখন কেবল ধু ধু বালুচর। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট: ধলাই নদীর উৎসমুখে স্বচ্ছ জলরাশির ঢেউ ও সবুজ পাহাড়ের আলিঙ্গন এবং অজস্র সাদা পাথরের সমাহার একসময় এই স্থানকে পরিণত করেছিল এক অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধারে। পর্যটকরা ভিড় করতেন দূরদূরান্ত থেকে। কিন্তু এখন, সেই সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যা দেখা যায় তা হলো ধু-ধু বালুচর, ধূলিকণায় আচ্ছন্ন প্রান্তর এ যেন আরবের মরুভূমি।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে অবস্থিত দেশের অন্যতম জনপ্রিয় অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি পর্যটন কেন্দ্র ‘সাদাপাথর’ আর নেই। গতবছরের ৫ অাগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পট পরিবর্তনের পর আমূল বদলে গেছে পাহাড়-নদী আর সবুজে বেষ্টিত সৌন্দর্যের লীলাভূমিটি। ভোলাগঞ্জের বালি, পাথর, নুড়িসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ এখন লুটেরাদের দখল-নিয়ন্ত্রণে।

বিজ্ঞাপন

সাদাপাথরের এই করুণ পরিণতির মূল কারণ অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবেশ বিধ্বংসী লুটপাট। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এসব কার্যক্রম সম্প্রতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনের ছত্রছায়ায় শুধুমাত্র গত দুই সপ্তাহেই প্রায় শত কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে এই এলাকা থেকে। একসময় যেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হতো গোপনে, আজ তা চলছে প্রকাশ্যেই।

একসময় যেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হতো গোপনে, আজ তা চলছে প্রকাশ্যেই। ছবি: সংগৃহীত

একসময় যেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হতো গোপনে, আজ তা চলছে প্রকাশ্যেই। ছবি: সংগৃহীত

প্রশাসন নামমাত্র অভিযান চালিয়ে লুটপাটের দায় এড়ানোর চেষ্টা করলেও লুটেরাদের সঙ্গে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অসৎ’ লোকজন জড়িত। সেকারণে আপত্তি-অভিযোগ জানিয়েও ফল হয়নি। ‘রাজনীতি ও প্রশাসনের কিছু অসৎ েলাকের সমন্বিত এই চক্রটি’ প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের শিকড় অনেক গভীরে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

দেড় যুগে ভোলাগঞ্জ কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা ও সংলগ্ন বাংকার এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ঘটনায় অন্তত ৩৮ শ্রমিকের প্রাণ গেলেও লুটপাটকারীদের কাউকে কোনোদিন বিচারের মুখোমুখি হয়ে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। বরং, লুটপাটকে ‘থামাচাপা দেওয়ার প্রশাসনিক চেষ্টায়’ মূলত লুটপাটকারীদের হাতকেই শক্তিশালী করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পরিবেশবিদদের।

পাথরের প্রশাসনের অবস্থান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন নাহার সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবৈধ উত্তোলন বন্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে স্থানীয়ভাবে যেসব চক্র সক্রিয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে আরও সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’

একসময় যেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হতো গোপনে, আজ তা চলছে প্রকাশ্যেই। ছবি: সংগৃহীত

একসময় যেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হতো গোপনে, আজ তা চলছে প্রকাশ্যেই। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট পরিবেশ অধিদফতর বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তবে, লোকবল ও প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না।’

সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আব্দুল করিম কিম ক্ষোভের সঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেভাবে পাথর লুট হচ্ছে, তা একেবারেই পরিবেশবিধ্বংসী। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই মরুভূমিতে পরিণত হবে এই জনপদ। পর্যটকরা ধলাই নদের উৎসমুখে উজান থেকে গড়িয়ে আসা পাথরের সৌন্দর্য অবলোকন করতে বহুদূর থেকে ছুটে আসতেন। সেখানে এখন ধুধু বালুচর। পাথর খেকোদের সৃষ্ট গর্তে মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে।’

সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘লুটপাটকারীদের কোনো দল থাকে না। আমরা বারবার প্রশাসনকে বলেছি, লুটপাটের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এরই মধ্যে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা বিএনপি সভাপতির পদ স্থগিত ঘোষণা করেছে। পাথর লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমাদের দলের জিরো টলারেন্স অবস্থান।’

এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাদাপাথর লুট বন্ধে প্রশাসন সর্বোচ্চ কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই অভিযান হচ্ছে। আর এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

একসময় যেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হতো গোপনে, আজ তা চলছে প্রকাশ্যেই। ছবি: সংগৃহীত

একসময় যেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হতো গোপনে, আজ তা চলছে প্রকাশ্যেই। ছবি: সংগৃহীত

তবে সিলেটের জনগণ প্রশাসনের এসব কথা আস্থা রাখার মতো মনে করছেন না। তাদের মতে, এই অভিযানগুলো শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে। বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়েনি।

সাদাপাথরের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য শুধু স্থানীয় পর্যটন শিল্পেরই নয়, পুরো দেশের পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশাল সম্ভাবনার এই স্থান আজ পরিণত হয়েছে শুধুই হাহাকারের প্রতীকে। এক সময়ের পর্যটন স্বর্গ, যেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেড়াতে যেতেন মানুষ, আজ সেখান থেকে ফিরতে হয় হতাশ হয়ে। চোখে পড়ে ধুলা, শুষ্কতা আর পরিবেশ বিধ্বস্ত করার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শূন্যতা।

সারাবাংলা/পিটিএম

ঝরনা ধু ধু বালুচর সাদাপাথর সিলেট