চট্টগ্রাম ব্যুরো: গতকাল (রোববার) ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজা, যে পূজা চট্টগ্রামে খুবই সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। গভীর রাত পর্যন্ত সীতাকুণ্ড উপজেলার ছলিমপুরের বাংলাবাজারে জেলেপাড়ায় পূজার উৎসবে মেতেছিল সবাই। কে জানতো, আনন্দ দিনের পরের ভোরটাই আসছে তাদের জন্য বিষাদের বার্তা নিয়ে!
সোমবার (১৮ আগস্ট) চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানার সিটি গেইটে সড়কে দাঁড়ানো একটি কাভার্ডভ্যানে সীতাকুণ্ড থেকে আসা পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দেয়। এতে পিকআপের পাঁচ যাত্রী নিহত ও চারজন আহত হন।
নিহতরা হলেন- আকাশ দাস (২৬), অজিত দাস (২৪), রনি দাস (২৫), জুয়েল দাস (১৮) ও মো. সোহাগ (৩২)। এদের চারজনই বাংলাবাজার জেলেপাড়ার বাসিন্দা। সোহাগ পিকআপ ভ্যানের চালক। তার বাড়িও সীতাকুণ্ডে।
সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের লাশ সামনে রেখে আহাজারি করছিলেন আকাশ দাসের মা। একটিবার ছেলেকে পাবার জন্য মায়ের আকুতিতে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন উপস্থিত লোকজনও।
তার বন্ধু বিলাস দাস সাংবাদিকদের বলেন, ‘আকাশ, অজিত, রনিসহ আমরা বন্ধুরা গতকাল সারাদিন মনসা পূজা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে ছিলাম। ভোরে শুনি, তাদের পিকআপ সিটি গেইটে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। প্রথমে সিটি গেইট আসি। সেখান থেকে হাসপাতালে আসি। কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না !’
জুয়েল দাসের বাবা গোপন দাস উদভ্রান্তের মতো হাসপাতালে ছেলের লাশ খুঁজছিলেন। ছেলের নিথর মুখ দেখে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘মনসাপূজা নিয়ে জুয়েল সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে ছিল। সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে রাতে আবার বের হচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি ফিরতে বললাম। ১০০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। রাতে আর ফিরল না। সকালে শুনলাম, আমার ছেলে আর নেই!’
অজিত দাসের স্ত্রী টকি রাণীকে কোনোমতেই সামলানো যাচ্ছিল না। আহাজারি করতে করতে বারবার ছুটে গিয়ে মৃত স্বামীর বুকের ওপর পড়ছিলেন। তাদের তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে নবম শ্রেণিতে এবং ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সবার ছোট মেয়ের বয়স মাত্র দুই বছর। বাবাকে চেনার আগেই পিতৃহীন হলো মেয়েটি।
টকি রাণী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে পরীক্ষা দিতে স্কুলে গেছে। সে এখনও জানে না। ছোট মেয়েটা শুধু বাবা, বাবা করছে। আমি তাদের কী জবাব দেব ! তুমি আমাকে কোথায় ফেলে গেলে !’
নিহত রনি দাসের মা রাজবালা দাস জানান, ছেলের যখন দেড় বছর বয়স তখন তিনি স্বামীকে হারান। একমাত্র ছেলেকে অনেক কষ্টে বড় করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে। বৌ এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘ছেলেটাও আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমি কারে নিয়ে বাঁচব, আমার বৌমা কীভাবে বাঁচবে! তার সন্তান এসে কারে বাবা ডাকবে ?’
আকাশের বন্ধু বিলাস জানান, চট্টগ্রাম নগরীর ফিশারিঘাট থেকে মাছ কিনে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট বাজারে নিয়ে তারা বিক্রি করেন। প্রতিদিন ভোরে তারা ফিশারিঘাটে পৌঁছেন। সকালের মধ্যে পিকআপ ভ্যানে মাছ নিয়ে বিক্রির জন্য বাজারে পৌঁছে যান। বিলাস ভোরে ঘুম থেকে উঠতে না পারায় তাকে রেখেই অন্যরা ফিশারিঘাটে যাচ্ছিলেন। পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
আকবর শাহ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, পিকআপ ভ্যানে চালকসহ মোট ১০ জন ছিলেন। এর মধ্যে সামনে চালকসহ তিনজন বসেছিলেন। পেছনে ছিলেন আরও সাতজন।
তিনি আরও বলেন, ‘সড়কে দাঁড়ানো ছিল কাভার্ডভ্যান। পিকআপ ভ্যানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাভার্ড ভ্যানের নিচে ঢুকে পড়ে। চালকসহ সামনে থাকা তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করা হয়। এরপর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ হতাহতদের উদ্ধার করে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও দুজন মারা যান। এছাড়া, চিকিৎসাধীন আছেন চারজন।’
ওসি আরও জানান, পিকআপ ভ্যানটির সামনের অংশ পুরোপুরি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ ভ্যান জব্দ করে থানায় নেওয়া হয়েছে। কাভার্ডভ্যানের চালক-সহকারী কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে সড়কে অবৈধ পার্কিংয়ের অভিযোগে যানবাহনটির বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে।