Saturday 23 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্বরূপে ফিরছে ‘সাদাপাথর’, ফিরছেন পর্যটকরা

জুলফিকার তাজুল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২৩ আগস্ট ২০২৫ ২৩:১৬

হাজারো পর্যটক প্রতিদিন সাদাপাথরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসছেন। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট: নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের এক লীলাভূমির নাম সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ। সীমান্তের কোলঘেঁষে পাহাড়-মেঘ-নদীর অপূর্ব সমন্বয়ের সেই জায়গার একটি বিখ্যাত পর্যটন স্পট ‘সাদাপাথর’। এটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি, যেখানে স্বচ্ছ জলের নিচে দেখা মেলে সাদা পাথরের। সেইসঙ্গে চারপাশের সবুজ পাহাড় আর দিগন্তজোড়া নীল আকাশের ভাসমান মেঘ যেন তৈরি করে অন্যরকম এক অনুভব।

তবে সম্প্রতি সেই অনুভবে আঁচড় ফেলে কিছু দুষ্কৃতিকারী। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ওই এলাকা থেকে দুষ্কৃতিকারীরা লুটে নিয়ে যায় কয়েকশ’ কোটি টাকার সাদা পাথর। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং স্থানটির নান্দনিকতা হারানোর আশঙ্কায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট অনেকেই দুশ্চিন্তায় পড়েন। যদিও প্রশাসনের তাৎক্ষণিক অভিযানে লুট হওয়া সেই সাদা পাথরের কিছুটা উদ্ধার করে আগের জায়গায় ফেলা হয়েছে। তার পরও অনেকে ভেবেছিলেন, এত নেতিবাচক ঘটনার পর পর্যটকরা হয়তো আর আসবেন না।

বিজ্ঞাপন
পাথর লুটের ঘটনা প্রকৃতিপ্রেমীদের ভালোবাসায় বাধা হতে পারেনি। ছবি: সারাবাংলা

পাথর লুটের ঘটনা প্রকৃতিপ্রেমীদের ভালোবাসায় বাধা হতে পারেনি। ছবি: সারাবাংলা

কিন্তু বাস্তবতা একদম ভিন্ন। প্রকৃতি হারায়নি আকর্ষণ, পর্যটকের ভিড় এখনো অব্যাহত। পাথর লুটের ঘটনা প্রকৃতিপ্রেমীদের ভালোবাসায় বাধা হতে পারেনি। হাজারো পর্যটক এখনও প্রতিদিন সাদা পাথরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসছেন। নৌকায় চড়ে ধলাই নদীর স্বচ্ছ পানিতে গা ভাসিয়ে, সাদা পাথরের ওপর হেঁটে বেড়িয়ে কিংবা পাহাড়ের কোলে বসে ছবির মতো দৃশ্য উপভোগ করছেন।

ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক শেখ ওয়াসিফ ওয়াসাল প্রাপন সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘লুটপাটের খবর শুনে আমরা একটু শঙ্কিত ছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি, এখনো জায়গাটা দারুণ। প্রকৃতি এখনও আগের মতোই মোহনীয়। প্রশাসনও দেখছি অনেক সক্রিয়।’

ফিরিয়ে আনা হচ্ছে সাদাপাথরের জৌলুশ

সিলেট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে লুট হওয়া পাথর পুনঃস্থাপনের কাজ। উদ্ধার করা পাথর ফের মূল এলাকাতে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য অনেকটাই ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সিলেটের নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ‘আমরা এই এলাকা রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। একদিকে পর্যটন অব্যাহত রাখতে চাই, অন্যদিকে প্রকৃতি ও পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়, সেটাও নিশ্চিত করছি।’ সাদাপাথর লুটের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

সিলেট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয়েছে লুট হওয়া পাথর পুনঃস্থাপনের কাজ। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয়েছে লুট হওয়া পাথর পুনঃস্থাপনের কাজ। ছবি: সংগৃহীত

জনপ্রশাসন সচিবের বিশেষ নির্দেশনা

সাদাপাথরের গুরুত্ব অনুধাবন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেছেন, সাদাপাথরসহ অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রকে ঘিরে বিশেষ প্যাকেজ কর্মসূচি নেওয়া হবে। পর্যটন নিরাপত্তা জোরদারে পুরো এলাকা থাকবে ২৪ ঘণ্টা সিসি ক্যামেরার আওতায়। তিনি স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশনাও দিয়েছেন। একইসঙ্গে পরিকল্পনা করা হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী পর্যটন ব্যবস্থাপনা, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের লুটপাট ঠেকানো যায় এবং স্থানীয় জনগণও উপকৃত হয়। তিনি বলেন, ‘সাদাপাথর শুধু একটি প্রাকৃতিক স্থান নয়, এটি বাংলাদেশের পর্যটনের সম্ভাবনার প্রতীক। আমরা একে রক্ষা করব, উন্নত করব এবং আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলব।’

স্থানীয়দের প্রত্যাশা

সাদাপাথর এলাকার অনেকেই সরাসরি পর্যটন নির্ভর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কেউ নৌকা চালান, কেউ খাবারের দোকান বা হোটেল চালান, কেউবা গাইড হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এই নতুন উদ্যোগে আশাবাদী। স্থানীয় নৌ-চালক সাইদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন ব্যবসা কমে গিয়েছিল। কিন্তু, এখন আবার মানুষ আসছে। প্রশাসন খুব সচেষ্ট, তাই আমরা সাহস পাচ্ছি।’

একই সুপের কথা বললেন ব্যবসায়ী মোকাব্বির। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এত কিছুর পরও পর্যটকরা আসছেন। তারা এখন নিরাপদ বোধ করছে। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকুক।’

উদ্ধার করা পাথর ফের মূল এলাকাতে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

উদ্ধার করা পাথর ফের মূল এলাকাতে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

প্রয়োজন সকলের সমন্বিত প্রয়াস

সাদাপাথর আজ শুধু একটি দর্শনীয় স্থান নয়, বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ ও জনসম্পৃক্ত উন্নয়নের একটি সফল উদাহরণ হয়ে উঠছে। লুটের আঁধার কাটিয়ে প্রশাসনের তৎপরতা, সচিব পর্যায়ের নজরদারি এবং স্থানীয় ও পর্যটকদের অংশগ্রহণে এটি আবারও তার হারানো গৌরব ফিরে পাচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বিত উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে, সাদাপাথর শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রেও নিজের জায়গা করে নিতে পারবে বলে বিশ্বাস পরিবেশবিদদের।

জার্নালিস্ট ট্যুরিস্ট ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাদিকুর রহমান সাকী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাদাপাথর শুধু একটি পর্যটন স্থান নয়, এটি আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় অর্থনীতির এক অপূর্ব মিলনস্থল। এখানে লুটপাটের ঘটনা যেমন দুঃখজনক, ঠিক তেমনি প্রশাসনের দ্রুত ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ আমাদের আশান্বিত করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটক হিসেবে শুধু জায়গাটি উপভোগ করতে আসা নয়, বরং এর টিকে থাকার জন্যও দায়িত্ববোধ থাকা জরুরি। প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের সমন্বয়েই সাদাপাথরকে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।’

বর্তমান প্রেক্ষাপটের পর প্রশাসনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় এমন উদ্যোগের পাশে থাকব। সাদাপাথরের সৌন্দর্য যেমন অমূল্য, তেমনি এর সংরক্ষণও আমাদের সবার সম্মিলিত দায়িত্ব।’

সারাবাংলা/পিটিএম

কোম্পানীগঞ্জ সাদাপাথর সিলেট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর