সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের চলনবিল—উত্তরবঙ্গের বিশাল জলাভূমি, যাকে অনেকে বলেন ‘মৎস্য ভাণ্ডার’। বর্ষা এলেই থইথই পানিতে ভরে ওঠে বিল। একসময় এই বিলে মাছ ধরেই সংসার চলত বহু নিম্ন আয়ের মানুষের। কিন্তু মাছের প্রাচুর্য কমে যাওয়ায় এখন তারা ভরসা করছেন শামুক-ঝিনুকের ওপর।
স্থানীয়রা জানান, বর্ষাকালীন জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে এই শামুক সংগ্রহের মৌসুম। প্রতিদিনই জেলার নদী, খাল ও বিল থেকে শত শত নিম্ন আয়ের নারী-পুরুষ শামুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সংগ্রহ করা শামুক তারা বস্তা প্রতি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করেন। এই সামান্য আয়ে কোনোরকমে সংসার চলে তাদের।
তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের মাকড়শোন এলাকায় শামুক বেচাকেনার জন্য একটি ভাসমান হাট গড়ে উঠেছে। এই হাটে পাইকারি হিসেবে বেচাকেনা হয় বিভিন্ন ধরনের শামুক। পাবনা, নওগাঁ, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এখান থেকে শামুক কিনে হাঁসের খামারিদের কাছে বিক্রি করেন।
মাকড়শোন এলাকার ভাসমান শামুকের হাটের ব্যবসায়ী শান্ত শেখ বলেন, ‘ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত এই হাটে পাইকারি দরে শামুক বেচাকেনা হয়। সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে বস্তা হিসেবে শামুক কেনা হয়। এলাকার দরিদ্র নারী ও পুরুষরা শামুক সংগ্রহ করে এখানে নিয়ে আসেন। তাদের কাছ থেকে কিনে আমরা বিক্রি করি।’
জীবিকার টানে পানির নিচে
মাকড়শোন হাটে শামুক বিক্রি করতে আসা কুন্দইল গ্রামের শামীম বলেন, “একসময় মাছ ধরেই সংসার চলত। এখন মাছ নেই, তাই শামুক কুড়াতে হয়। প্রতিদিন ২–৩ বস্তা শামুক কুড়িয়ে বিক্রি করি। সেই টাকাতেই ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার তুলে দিই।”
মাগুড়া বিনোদ গ্রামের জেলে হানিফ, রবিউল শেখ, মামুন হোসেন, ‘সোলাইমান জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে ৬ থেকে ৭ জনের একটি দল নৌকা নিয়ে চলনবিলে যান। নৌকায় করে মই জাল, হেসি জাল ও হাত জাল দিয়ে সারারাত শামুক সংগ্রহ করেন। সকালে শামুকগুলো প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে হাটে নিয়ে যান। শামুক বেচে টাকা সবাই ভাগ করে নেন।’
তাড়াশের মান্নান নগর গ্রামের শফিকুল বলেন, ‘শামুক সংগ্রহের জন্য একটি দল নৌকা ও জাল নিয়ে চলনবিলের নদ-নদীসহ বিভিন্ন খালবিলে ছুটে চলি। সারারাত জাল ফেলে শামুক সংগ্রহ করি। সকালে শামুক থেকে ময়লা ফেলে ৩৫ থেকে ৪০টি প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। এতে প্রতিদিন ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকার শামুক বিক্রি হয়। যে টাকা আয় হয়, তা সবাই ভাগাভাগি করে নেই।’
নওগাঁ থেকে তাড়াশের মাকড়শোন ভাসমান হাটে শামুক কিনতে আসা পাইকার সুজন মিয়া বলেন, ‘পুষ্টি গুণসম্পন্ন খাদ্য হওয়ায় হাঁসের খামারিদের কাছে শামুক ও ঝিনুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই হাট থেকে শামুক সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন জেলার হাঁসের খামারি ও মাছের ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করি।’
শামুক ব্যবসায়ী মমিন তালুকদার বলেন, ‘চলনবিলাঞ্চলে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ জন ব্যবসায়ী আছেন। বিল থেকে তোলা শামুক ও ঝিনুক স্থানীয় সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে কিনে পাইকারি দরে আড়তে বিক্রি করা হয়। বর্ষার তিন থেকে চার মাস শামুক কেনা-বেচা হয়।’
শামুক শুধু অর্থনৈতিক সম্পদ নয়, প্রকৃতি ও কৃষির জন্যও অত্যন্ত জরুরি। তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিদ্যুৎ কুমার বলেন, “নির্বিচারে শামুক নিধনের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। শামুক পানি বিশুদ্ধ রাখে, মাছের খাদ্য যোগায়, এমনকি মাটির উর্বরতাও বাড়ায়। প্রতিদিন চলনবিল থেকে প্রায় ২০০ টন শামুক তোলা হচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।”
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান জানান, শামুকের ভেতরের অংশ মাছ ও হাঁসের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আর খোলস কাজে লাগে সার ও চুন তৈরিতে। তবে নির্বিচারে শামুক নিধন দীর্ঘমেয়াদে কৃষি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেন, “শামুক প্রাকৃতিক সম্পদ। অতিরিক্ত নিধন রোধে প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”