রাজশাহী: দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট-এ ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচন। বুধবার (১৬ অক্টোবর) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কেন্দ্রে একযোগে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এর জন্য সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
নির্বাচনের আগে কয়েকদিন ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। এরই মধ্যে অনু্ষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শেষ হলেও শিক্ষার্থীরা টুকিটাকি চত্বর, পরিবহণ চত্বর ও হলগুলোয় আলোচনা করছেন সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থী ও নির্বাচনি ইশতেহার নিয়ে।
জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ১১টি প্যানেল। শীর্ষ তিন পদ—সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে হবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ভিপি পদে লড়ছেন ১৮ জন, জিএস পদে ১৩ জন এবং এজিএস পদে লড়ছেন মোট ১৬ জন।
দীর্ঘ ৩৫ বছরের বিরতি
১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৪ বার চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালের ১৯ জুলাই। এবার হতে যাচ্ছে ১৫তম রাকসু নির্বাচন।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা
এবারের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৩টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৪৭ জন। হল সংসদের জন্য ৫৯৭ জন এবং সিনেট-এ ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ৫৮ জন প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাচনে ১১টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ভিপি পদে প্রার্থী ১৮ জন, জিএস পদে ১৩ জন এবং এজিএস পদে ১৬ জন।
নির্বাচনি প্রস্তুতি
এবার নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে হবে নয়টি অ্যাকাডেমিক ভবনের ১৭টি কেন্দ্রের ৯৯০ বুথে। এরই মধ্যে বুথ স্থাপনসহ সব কাজ শেষ করেছেন নির্বাচন কমিশন। প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১০ মিনিটে দিতে হবে ৪৩ ভোট
একজন ভোটারকে রাকসু নির্বাচনে মোট ২৩টি পদে, হল সংসদ নির্বাচনে ১৫টি পদে ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে ৫টি পদে মিলিয়ে মোট ৪৩টি ভোট দিতে হবে। এসব ভোট দিতে ভোটার সময় পাবেন ১০ মিনিট। ফলে গড়ে প্রায় ১৪ সেকেন্ডে একটি করে ভোট দিতে হবে শিক্ষার্থীকে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়ানো ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন।
শীর্ষ পদে কারা আলোচনায়
ভিপি পদে শিক্ষার্থীদের আলোচনায় রয়েছেন শেখ নূর উদ্দিন আবীর (‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’- ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল), মোস্তাকুর রহমান জাহিদ (‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’- ছাত্রশিবির সমর্থিত), তাসিন খান (সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ), ফুয়াদ রাতুল (‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’-বাম সমর্থিত প্যানেল) এবং মেহেদী মারুফ (‘রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’)।
জিএস পদে আলোচনায় আছেন নাফিউল ইসলাম জীবন (ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম), ফাহিম রেজা (সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট), সালাহউদ্দিন আম্মার (অধিপত্যবিরোধী ঐক্য) এবং কাউছার আহম্মেদ (গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ)।
এছাড়া, এজিএস পদে শিক্ষার্থীদের আলোচনায় আছেন জাহিন বিশ্বাস এষা (ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম), সালমান সাব্বির (সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট) ও শাহ পরান (স্বতন্ত্র প্রার্থী)।
নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ
রাকসু নির্বাচনে এবার ৪৭ জন নারী প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। তবে শীর্ষ তিন পদে মাত্র একজন নারী— চৌধুরী তাসনীম জাহান শ্রাবণ (জিএস পদে)। এজিএস পদে অংশ নিচ্ছেন জাহিন বিশ্বাস এষা, ছাবেকুন নাহার ও জান্নাতুল ফেরদৌস।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা
বহু শিক্ষার্থী আশা করছেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন। প্রার্থীদের নির্বাচনি ইশতেহারে উঠে এসেছে আবাসনের সংকট, হলের খাবারের মান, নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা এবং ক্যাম্পাস পরিবেশ উন্নয়নের বিষয়গুলো। এছাড়া ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়েও প্রার্থীরা উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন।
নিরাপত্তাব্যবস্থা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের দিন ক্যাম্পাসজুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাসে থাকবে দুই হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য, ছয় প্লাটুন বিজিবি ও ১২ প্লাটুন র্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা, বিএনসিসি ও স্কাউট সদস্যদের বিশেষ টহল ও দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা।
এ বিষয়ে রাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক সেতাউর রহমান বলেন, ‘রাকসু নির্বাচনের প্রায় সকল কাজ আমরা এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছি। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতিও ঠিকঠাক রয়েছে। আমরা আশা করছি আগমীকাল আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুন্দর নির্বাচন দেখতে পারব।’
পরিবহণ ব্যবস্থা
প্রক্টর অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্বাচনের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত যানবাহন ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন প্রবেশ, চলাচল ও অবস্থান করতে পারবে না। তবে, শারীরিকভাবে বাধাগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা এ নিয়মের বাইরে থাকবেন। গণমাধ্যমকর্মীরা কমিশনের দেওয়া পাস প্রদর্শন করে প্রবেশ করতে পারবেন। অ্যাকাডেমিক ভবনে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা নিষিদ্ধ থাকবে, তবে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট যানবাহন অব্যাহত থাকবে। সেদিন মোটরসাইকেল চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।
শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ানো
ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের সহকারী সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী জাহিন বিশ্বাস এষাকে সমর্থন জানিয়ে গতকাল দুপুরে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র এজিএস প্রার্থী ফজলে রাব্বি।
তিনি বলেন, ‘আমার ইশতেহারের সঙ্গে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহারসমূহ সম্পূর্ণ মিলে যাওয়াতে আমি এই প্যানেলের এজিএস প্রার্থীকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
একই দিন রাতে মেরাজুল ইসলাম নামে আরেকজন এজিএস প্রার্থী এষাকে সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান।ৎ
উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ হাজার ৯০১ জন শিক্ষার্থী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে ছাত্রী ১১ হাজার ৩০৫ জন এবং ছাত্র ১৭ হাজার ৫৯৬ জন। কেন্দ্রীয় সংসদ, হল সংসদ ও সিনেট প্রতিনিধি মিলিয়ে মোট ৯০১ জন প্রার্থী এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।