চট্টগ্রাম ব্যুরো: মধ্যপ্রাচ্যে হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে ‘একমুঠো সুখ’ নিয়ে ফেরার কথা ছিল তাদের। সেই সুখ নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে গিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্নে বেছে নিয়েছিলেন প্রবাস জীবন। কিন্তু দরিয়াপাড়ের জীবনে তাদের সুখের ফেরা আর হলো না। সাগরের কাঁধে চেপে তাদের কফিনবন্দি লাশ গেল ঘরে।
গত ৮ অক্টোবর ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আট প্রবাসীর মরদেহ শনিবার (১৮ অক্টোবর) রাতে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। নিহতদের মধ্যে সাতজন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের বাসিন্দা।
আজ (রোববার) সকালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপে সাগরপথে চালু হওয়া স্পিডবোটে সাতজনের মরদেহবাহী কফিন নিয়ে যাওয়া হয় নিজ এলাকায়। চোখের সামনে একসঙ্গে এত লাশ, স্বজনদের আহাজারি তো ছিলই, কান্নায় ভিজেছে ঘাটপাড়ের মানুষ, নৌযানের মাঝিমাল্লা, গ্রামবাসী আর দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যাওয়া মানুষ।
নিহত আটজন হলেন- সন্দ্বীপের মোহাম্মদ আমীন (৫০), মো. সাহাবুদ্দিন (২৮), মো. বাবলু (২৮), মো. রকি (২৭), মো. আরজু (২৬), মো. জুয়েল (২৮) ও মোশারফ হোসেন (২৬) এবং রাউজান উপজেলার চিকদাইর গ্রামের মো. আলাউদ্দিন (২৮)।
জানা গেছে, গত ৮ অক্টোবর ওমানের ধুকুম প্রদেশের সিদরা এলাকায় আট প্রবাসীকে বহনকারী একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে অন্য একটি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তারা ঘটনাস্থলেই নিহত যান। মোহাম্মদ আমীনের নেতৃত্বে তারা সবাই সাগরে মাছ ধরার পেশায় ছিলেন। সেদিনও সাগরে মাছ শিকার করে ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার ১০ দিন পর গতকাল (শনিবার) আটজনের মরদেহ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। বিমানবন্দরের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল সারাবাংলাকে জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তাদের লাশ চট্টগ্রামে পৌঁছে। নিহতদের স্বজনেরা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাশ বুঝে নেন। এ সময় বিমানবন্দরে স্বজনদের আহাজারিতে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
এদিকে আজ (রোববার) সকালে সাতজনের লাশ নেওয়া হয় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা ঘাটে। সেখান থেকে স্পিডবোটে করে শেষবারের মতো তারা কফিনবন্দি হয়ে সাগর পাড়ি দেন। নিহত রাউজানের আলাউদ্দিনের মরদেহও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মং চিনু মারমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সকালে মরদেহ নিয়ে সন্দ্বীপে পৌঁছান স্বজনরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবধরনের সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। সকাল সাড়ে নয়টায় পূর্ব সন্দ্বীপ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একসঙ্গে সবার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জানাজায় কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। এরপর তাদের নিজ গ্রামে দাফন করা হয়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সন্দ্বীপের নিহত সাতজনের মধ্যে মোহাম্মদ আমীন ছাড়া বাকি ছয়জনের পরিবারই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল। আমীন দীর্ঘসময় ধরে প্রবাসে থাকার কারণে মোটামুটি আর্থিকভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ডিসেম্বরে দেশে ফিরে বড় মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করার কথা তিনি পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন।
নিহত বাকি সবার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা আছেন। তাদের মধ্যে চারজন প্রথমবারের মতো বিদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু সংসারের স্বচ্ছলতা ফেরানোর আগেই তাদের চলে যেতে হল পরপারে।