ঢাকা: আসছে ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন— প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এরকম কথা বারবার বলার পর মোটামুটি ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, যেভাবেই হোক নির্ধারিত মাসেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। তবে এখন পর্যন্ত নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন। এদিকে সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই মানুষ জানতে উদগ্রীব— কবে নির্বাচন?
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র বলছে, আগামী বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ইসি। সেজন্য জোর প্রস্তুতি চলছে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাও সারাবাংলাকে ‘৮ ফেব্রুয়ারি’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, আগামী বছরের ৫, ৮ ও ১২ ফেব্রুয়ারি-এই তিনটি তারিখ নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ ও ১২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার, আর ৮ ফেব্রুয়ারি রোববার। তবে ৮ তারিখের আগে শুক্র ও শনিবার দু’দিন সরকারি ছুটি রয়েছে। ফলে শহরে বসবাসকারী ভোটাররা, বিশেষ করে চাকরিজীবীরা ছুটির দিনে নিজের এলাকায় গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। সেজন্য ওই তারিখটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার নির্বাচন হলে ভোটারদের নিজস্ব এলাকায় যেতে বুধবার ছুটি নিতে হবে, যা অনেকের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। এ কারণে নির্বাচন কমিশনের বেশিরভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই ৮ ফেব্রুয়ারি (রোববার) ভোটের পক্ষেই মত দিয়েছেন। তাই সব মিলিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনাই বেশি।’
ইসির প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পোস্টাল ভোটসহ বেশকিছু বিষয় বিবেচনায় রেখে এবার তফসিল ঘোষণা ও ভোটগ্রহণের মধ্যে বেশি সময় হাতে রাখতে চাইছে ইসি। অন্যান্য সময় তফসিল থেকে ভোটগ্রহণে সর্বোচ্চ দেড় মাসের মতো ব্যবধান থাকলেও এবার প্রায় দুই মাস রাখার পরিকল্পনা তাদের। সেইসঙ্গে পরীক্ষার সূচি, শিক্ষার্থীদের যাতায়াত, সম্ভাব্য আবহাওয়া পরিস্থিতি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম যাতে পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, সেসব বিষয়ও রয়েছে পর্যালোচনায়। সবকিছু মিলিয়ে প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে নির্বাচন আয়োজনকারী এই সংস্থাটি।
এরই মধ্যে আইন ও বিধি সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন যাবতীয় নির্বাচনি সামগ্রী ছাপানোর কাজ শেষ হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নির্বাচনের জন্য ৩৪ হাজার মনোনয়নপত্র, প্রায় ৫ লাখ ফরম, ১০ হাজার প্রতীকের পোস্টার, পরিচয়পত্র ও নির্বাচনি প্যাকেট। এখন ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে মোট ২৫ কোটি ৫৪ লাখ ব্যালট প্রিন্ট করা হবে। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ২০ লাখ বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটের মধ্যে ১৭ লাখ এরই মধ্যে প্রস্তুত।
পর্যবেক্ষক নীতিমালা ১০ হাজার পিস, প্রিজাইডিং অফিসারদের জন্য ৪৩ হাজার পরিচয়পত্র, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের জন্য তিন লাখ এবং পোলিং অফিসারদের জন্য ৬ লাখ পরিচয়পত্র ছাপানোর কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া পোলিং এজেন্টদের জন্য ৩২ লাখ পরিচয়পত্রের কাজও শেষ হয়েছে।
জানা গেছে, যেহেতু গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একদিনে হবে, তাই গোপন কক্ষের সংখ্যা বাড়ানোর কথা ভাবছে ইসি। সেইসঙ্গে ভোটের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে নয় ঘণ্টা করা হতে পারে। সকাল-বিকেল দুই দিকেই সময় বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। এখন সকাল ৮ থেকে ভোট শুরু হয়, সেটা সাড়ে সাতটায় হতে পারে। আবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট হয়, সেটা সাড়ে চারটা করার কথা ভাবা হচ্ছে।
এদিকে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন করতে সারাদেশে ৪২ হাজার ৭৬১টি কেন্দ্র চূড়ান্ত করেছে ইসি। মোট ভোটকক্ষ নির্ধারিত হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯টি। যার মধ্যে নারী ভোটকক্ষ ১ লাখ ২৯ হাজার ৬০২টি এবং পুরুষ ভোটকক্ষ ১ লাখ ১৫ হাজার ১৩৭টি।
সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সরকারের পক্ষ থেকে গণভোটের সময় জানানোর পর অতিরিক্ত ব্যালট পেপার, ভোটদান কক্ষ, বাজেট বৃদ্ধিসহ বেশকিছু অতিরিক্ত প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে তাদের। সেইসঙ্গে ভোট স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার, কেন্দ্রের আশপাশের সিসিটিভি ব্যবহার, বিতর্কিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে মুক্তি, মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা এবং মাঠে মেডিকেল ও ফায়ার সার্ভিস রাখার মতো ব্যবস্থা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।
এবারও সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারে ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ইসি। সম্ভাব্য নাশকতা ঠেকাতে এসব এলাকায় বাড়তি টহল, সিসিটিভি নজরদারি ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রের আশপাশের সিসিটিভিও ব্যবহৃত হবে
ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার ভোট পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রের ভেতরে সিসিটিভি ক্যামেরার পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রের আশপাশে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ভবনে থাকা ক্যামেরাও ব্যবহার করা হবে। এতে করে কেন্দ্রের বাইরে ঘটতে যাওয়া সম্ভাব্য কোনো অনিয়ম বা অপ্রীতিকর ঘটনার ফুটেজও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া, নির্বাচনি প্রচারের কিছু অংশ সংসদ টিভির মাধ্যমে প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তার আশপাশের সড়ক উন্নয়ন বা সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে গত তিন জাতীয় নির্বাচনের বিতর্কিত কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকবেন না। জানা গেছে, যাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মতো অভিযোগ আছে, কেবল তাদেরই দায়িত্বের বাইরে রাখা হবে। এ ছাড়া, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও বিশেষ করে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ভিসা, বিমানবন্দরে সহায়তা দেওয়াসহ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সহজ করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের কাছে জরুরি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হবে। বিশেষ করে বৃদ্ধ ভোটার, অসুস্থ ব্যক্তি বা ভিড়ের কারণে দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবা দিতে অ্যাম্বুলেন্সসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুত থাকবে। এছাড়া অগ্নিকাণ্ড, বজ্রপাত, ভূমিকম্পসহ যেকোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আলাদা দলও সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হবে বলে জানা গেছে।
এসবের বাইরে প্রাক-নির্বাচনি ও ভোট-পরবর্তী কার্যক্রম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে মাঠ প্রশাসনকে নির্বাচনি মালামাল পরিবহণ, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।