Wednesday 03 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একীভূত ৫ ব্যাংক
অন্ধকারে বিনিয়োগকারীরা, অডিট ফার্ম ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

আদিল খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৪৪ | আপডেট: ৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৪৯

ঢাকা: শরীয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক একীভূত হওয়ায় ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র আমানতকারীরা আশার আলো দেখলেও দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন বড় আমানতকারীরা। কিন্তু এখনো ঘোর অন্ধকারে রয়েছেন ব্যাংকগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা। তারা কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন, কিংবা আদৌ পাবেন কি না- এ বিষয়ে এখনো কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায় নি। ফলে চরম হতাশায় রয়েছেন পাঁচ ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ৫টি হচ্ছে— সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।

উল্লেখ্য, গত সোমবার (০১ ডিসেম্বর) ব্যাংকগুলোর একীভূত চূড়ান্ত করে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নামে সনদ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ব্যাংকগুলোর শেয়ারের মূল্য শূন্য ঘোষণা করে প্রশাসক ও নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিজ্ঞাপন

একীভূত ৫ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়ে গত ৫ নভেম্বর গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুইটির মূল্য এখন নেগেটিভ। তাই শেয়ারের ভ্যালু জিরো বিবেচনা করা হবে। কাউকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না।’

গভর্নরের এ বক্তব্যের বিষয়ে গত ৯ নভেম্বর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একীভূতের প্রক্রিয়াধীন পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেটা বলেছেন, সেটাই চূড়ান্ত কথা নয়। বিষয়টি সরকার দেখবে।’

পরবর্তীতে গত ১৮ নভেম্বর ৫ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা আমরা একেবারে ইগনোর করছি না। আমরা বিবেচনা করবো। জয়েন্টলি (অর্থ মন্ত্রণালয়-বাংলাদেশ ব্যাংক) আমরা দেখবো।’

এ বিষয়ে সর্বশেষ গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স বিভাগ থেকে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংকে আমানতকারীদের সুরক্ষার আওতায় কোনো ব্যাংক বা ফিন্যান্স কোম্পানি অবসায়ন বা বন্ধ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ফেরত পাবেন সাধারণ আমানতকারীরা। এর বাইরে আইনে কিছু করার নেই।

একীভূত ৫ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘লিকুইডেশনে গেলে সম্পদ বিক্রি করে দায়দেনা শোধ করার পর এবং আমানতকারীদের টাকা দেওয়ার পরে যদি কিছু থেকে থাকে, তাহলে শেয়ারহোল্ডাররা পাবে। আর যদি কিছু না থাকে, তাহলে তো শেয়ারহোল্ডাররা দাবি করতে পারে না। এটা হলো আইনের ভাষা।’

পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন বা যেকোনো আইনে, বিনিয়োগকারী বা শেয়ারহোল্ডাররা সবার দায়দেনা শোধ করার পরে কিছু থাকলে সেটা পায়। ওইসব ব্যাংকের কোনো কোনোটার ক্ষেত্রে শেয়ারপ্রতি সম্পদ (এনএভিপিএস) ৪৫০ টাকা ঋণাত্মক আছে। অর্থাৎ একটা শেয়ার কেনার মানে ৪৫০ টাকা দায় দিতে হবে। যেহেতু কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগের অ্যামাউন্ট দ্বারা সীমাবদ্ধ, সেই কারণে শেয়ারহোল্ডারদের দায়টা দিতে হচ্ছে না। কিন্তু নতুন করে সে কিছু পাচ্ছে না। এটা হচ্ছে বাস্তবতা।’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি’র কমিশনার মু. মোহসিন চৌধুরী বলেন, শেয়ারহোল্ডাররা যেহেতু মালিক, আর মালিকের ঘরে তো টাকা নেই, বরং ঋণাত্মক, তো এখন মালিক হয়ে টাকা পাবে কোথায়?

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উদ্যোক্তা ও পরিচালক বাদে ওই ৫ ব্যাংকের অন্য শেয়ারহোল্ডারদের হাতে থাকা শেয়ারের পরিমাণের গড় ৭৬ দশমিক শূণ্য ২ শতাংশ। অভিহিত মূল্যে এসব শেয়ারের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা।

এদিকে ৫ ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য শূন্য ঘোষণার পরপরই রাস্তায় নামেন ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। এসব কর্মসূচি থেকে কিছুদিন আগেও যে ৫ ব্যাংক ক্রেডিট রেটিং ও আর্থিক দিক থেকে উচ্চ অবস্থানে ছিল, সেগুলো কীভাবে মিলিয়ে গেল অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর আর্থিক হিসাব তথা অডিট রিপোর্টের সত্যতা ও স্বচ্ছতা এবং এগুলো যাচাই-বাছাইয়ের ভার যাদের ওপর বিশেষত অডিট ফার্ম ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা ও দায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেট (বিএএসএম) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী ‘সারাবাংলা‘-কে বলেন, ‘ব্যাংক একীভূত চিন্তা করে করা উচিত ছিল। শেয়ারহোল্ডারদের অবস্থা কী হবে, ডিপোজিটরদের অবস্থা কী হবে? এই যে প্রতিটা জায়গায় এখন ব্যাংকগুলোর যে শাখা আছে, এগুলো কীভাবে অ্যাকোমোডেট করবেন, এগুলো চিন্তাভাবনা না করে বলে দেওয়া হলো শেয়ারহোল্ডাররা কিছু পাবেন না। এটা হতে পারে নাকি?’

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ-এর সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী ‘সারাবাংলা‘-কে বলেন, ‘মার্জার প্রক্রিয়া যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে না করে ভিন্নভাবে করা হয়েছে। এই ৫ ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা কোথায় যাবে? কেউ কি দেখার নেই ? তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পুজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজটা কী। তারা কি লুটেরা গোষ্ঠীর দোসর? বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনে সব লুটপাট হয়েছে, এটি সবার জানা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও গভর্নর এর দায় এড়াতে পারেন না।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘৫ ব্যাংক মিলে একটি সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক করা হয়েছে। এখন গ্রাহকরা পর্যায়ক্রমে টাকা পাবে। আর শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারের মূল্য শূন্য হওয়ায় তা ফেরতের সম্ভাবনা নেই। সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় গ্রাহকের আস্থা ফিরবে। এটা ভবিষ্যতে শক্তিশালী ব্যাংক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।’