চট্টগ্রাম ব্যুরো: গত পাঁচ মাস ধরে অস্থির হয়ে আছে পেঁয়াজের বাজার। সর্বশেষ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাজারে খুচরায় পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ১৫০ টাকায় পৌঁছেছে। বাড়তি দামে ভোক্তার কষ্ট হলেও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মিলেছে আশাজাগানিয়া তথ্য। আমদানি এড়িয়ে বিশেষত, ভারত থেকে পেঁয়াজ আনা বন্ধ করে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই এবার চাহিদার প্রায় পুরোটা যোগান দিয়েছে বাংলাদেশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে বছরে প্রায় ৩৮ থেকে ৪০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৩২ লাখ মেট্রিক টনের মতো পেঁয়াজ দেশে কৃষকরা উৎপাদন করেন। বাকি সাত থেকে আট লাখ মেট্রিক টন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করা হতো ভারত থেকে। এরপর চীন, পাকিস্তান, মিশর, তুরস্ক থেকেও আমদানি করা হয়। যদি-ও এসব পেঁয়াজের চাহিদা দেশের বাজারে তেমন নেই বললেই চলে।
চলতি বছরে ফলন ভালো হওয়ায় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দেশীয় কৃষিপণ্য উৎপাদনমুখী নীতির কারণে ভারত থেকে আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। দেশের কৃষকদের উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই এবার মোটামুটি পুরো বছরটা পার করা গেছে, যা অতীতে কখনো হয়নি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পেঁয়াজের চাহিদাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, এজন্য আমদানিতে আগ্রহ ছিল না তাদের।
ভারত থেকে দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয় বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে। সেই পেঁয়াজ দেশের বিভিন্ন আড়তের পাশাপাশি বড় অংশ আসে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। এছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা পেঁয়াজের পুরোটাই পৌঁছে খাতুনগঞ্জের আড়তে। এরপর সেখান থেকে খুচরা বাজারে সরবরাহ করা হয়।
গত আগস্ট থেকে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পেঁয়াজের দর উর্ধ্বমুখী হয়ে আছে। অক্টোবরে এসে তা খুচরায় কেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত সপ্তাহ পর্যন্ত দেশি পেঁয়াজ মানভেদে ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহের প্রথমদিন শনিবার (৬ নভেম্বর) চট্টগ্রামে খুচরায় পুরনো দেশি পেঁয়াজ মানভেদে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে। বাজারে মেহেরপুরের আগাম ফলনের কিছু পেঁয়াজও এসেছে। সেগুলো প্রতিকেজি ১৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
খাতুনগঞ্জের আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার আড়ত থেকে মজুত দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর মেহেরপুরের নতুন পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়। তবে শনিবার পাইকারিতে দাম কিছুটা কমেছে। এদিন মজুত দেশি পেঁয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা এবং নতুন পেঁয়াজ ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের বৃহত্তর পাইকারি মার্কেট হামিদুল্লাহ মিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এতদিন ধরে দেশীয় যে পেঁয়াজটা বিক্রি করছিলাম, সেটার মজুত প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এটা শুধু খাতুনগঞ্জে শেষ হয়েছে, এমন নয়। পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া- এসব এলাকায় মোকামেও পেঁয়াজ নেই। এজন্য দাম কিছুটা বেড়েছে। আবার ভারত থেকে আমদানিও বন্ধ। সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি বন্ধ রেখেছে। সব মিলিয়ে বাজারে এখন কিছুটা ক্রাইসিস চলছে।’
এদিকে খাতুনগঞ্জের আড়তে এবং খুচরা বাজারে মেহেরপুরের আগাম ফলনের কিছু পেঁয়াজের সরবরাহ দেখা গেছে। কয়েকটি আড়তে ৮-১০ বস্তা করে নতুন পেঁয়াজ দেখা গেছে। নতুন পেঁয়াজ আসতে শুরু করলেও দামের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বাজারে সাধারণত ডিসেম্বর মাসে নতুন ফলনের মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসে। এর পর জানুয়ারি থেকে বাজারে আসে রাজবাড়ি, ফরিদপুর, মেহেরপুর, জামালপুর, কুষ্টিয়াসহ অন্যান্য জেলার পেঁয়াজ। চট্টগ্রামেও এখন পেঁয়াজের আবাদ হচ্ছে।
আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেহেরপুরের পেঁয়াজ, এটা আগাম ফলন, এটা মাত্র আসতে শুরু করেছে। এটা দিয়ে বাজার কাভার হবে না। চলতি মৌসুমের ফলন মাত্র ক্ষেত থেকে তোলা শুরু হয়েছে। সেটা মোকামে আসতে আরও সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। এরপর বাজারে আসতে লাগবে আরও সপ্তাহখানেক। সব মিলিয়ে পেঁয়াজের দাম কমার জন্য আরও মাসখানেক লাগবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম নিয়ে ঝামেলা থাকবে।’
আড়তদার ও আমদানি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরে পেঁয়াজ আমদানি কমেছে প্রায় ৯৮ শতাংশ। বছরের শুরুতে জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২০ হাজার মেট্রিক টনের মতো পেঁয়াজ ভারত থেকে দেশে ঢুকেছিল। জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে এসেছে ১৩ হাজার মেট্রিক টনের মতো। পাকিস্তান, চীন, মিশর, তুরস্ক থেকে খুবই সামান্য পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে।
পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বৃহত্তর চাক্তাই আড়তদার মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফোরকান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এবার দেশীয় পেঁয়াজ দিয়ে পুরো বছর একহাতের ব্যবসা হয়েছে। ভারতের কেরালা, মহারাষ্ট্র থেকে পেঁয়াজ আমদানি এবার ছিল না বললেই চলে। দেশীয় পেঁয়াজের সঙ্গে আমদানি থাকলে একটা প্রতিযোগিতা থাকে। তখন দাম স্থিতিশীল থাকে। তবে দেশীয় পেঁয়াজ দিয়েই যেহেতু বছরটা প্রায় পার করা গেছে, আমদানি তেমন করতে হয়নি, সেটাও একটা ভালো লক্ষণ।’
আমদানি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ভারত থেকে ৭ থেকে ৮ লাখ মেট্রিকটন পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো। কিন্তু ভারত নিজেদের সিদ্ধান্তে হঠাৎ রফতানি বন্ধ করে দিলে বারবার বিপাকে পড়তো বাংলাদেশ। পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যেত। ভোক্তাদের ভোগান্তি হতো। চলতি বছর আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রাথমিক ধাপ তৈরি করল বাংলাদেশ।
গেল মৌসুমে পেঁয়াজের ফলন যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি আমদানি না থাকায় কৃষকরাও ভালো দাম পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৪৪ লাখ মেট্রিকটন, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিকটন বেশি। তবে সংরক্ষণ জটিলতায় পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে বাজারে আসে ৩৩ লাখ টনের মতো।
আড়তদার মো. ইদ্রিস সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজারে আমরা পেয়েছি ৩৩ লাখ টনের কিছু বেশি পেঁয়াজ। ফলন ভালো হওয়ার পরও ঘাটতি প্রায় ৫-৬ লাখ টন। আমদানি বন্ধ থাকায় সেই ঘাটতি পূরণ হয়নি। কিন্তু গত এক-দেড় বছরে বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা কমেছে। ফলে মোটামুটিভাবে বছরটা সামাল দেওয়া গেছে। এ মৌসুমেও আমরা শুনেছি ফলন খুব ভালো হয়েছে। তাহলে হয়তো সামনেও আমাদের পেঁয়াজের সংকট তেমন হবে না। আমদানি যে কমছে, এটা ভালো হচ্ছে।’
তবে শুধুমাত্র দেশীয় পেঁয়াজের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে সিন্ডিকেটবাজি যাতে না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখার পরামর্শ দেন তিনি।