ঢাকা: ১২ ডিসেম্বর, শুক্রবার। সকাল থেকে নির্বাচনি প্রচারে ছিলেন সেগুনবাগিচা ও মতিঝিল এলাকায়। দুপুরে জুম্মার নামাজের পর তার যাওয়ার কথা ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কর্মীদের সান্নিধ্যে, দুপুরের খাবার খেতে। কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হলো না তার। পথেই বিজয় নগরের কালভার্ট রোড এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি। আর তার জীবনের জন্য প্রার্থনায় রয়েছেন দেশের লাখো মানুষ।
যার জন্য এখন দেশের মানুষের সীমাহীন প্রার্থনার হাত উত্তোলিত তিনি হলেন জুলাই আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নির্বাচনি মাঠে ছিলেন নতুন, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছিল। আর সেই বৃদ্ধিটাই তার জন্য কাল হলো। এখন জীবনের ছন্দপতনের সামনে দঁড়িয়ে তিনি। তার চিকিৎসা চলছে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে।
কে এই ওসমান হাদি
ঢাকার রাজনৈতিক পাড়ায় সম্প্রতি যে নামটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি শরিফ ওসমান হাদি। বয়স মাত্র তেত্রিশ। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এরই মধ্যে তিনি এই প্রজন্মের প্রতিরোধ চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। রাজপথে তার উচ্চকিত কণ্ঠ, আপসহীন অবস্থান ও ব্যক্তিগত জীবনের ত্যাগ তাকে এমন এক চরিত্রে পরিণত করেছে, যাকে একদিকে সমালোচিত হতে হয়, আবার অন্যদিকে আশা–বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
রাজপথে যার উত্থান
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাপ যখন দেশের প্রতিটি শহর–মফস্বলে ছড়িয়ে পড়েছিল, ঠিক সেই সময়ই নামটি বেশি উচ্চারিত হতে থাকে—শরিফ ওসমান হাদি। উত্তপ্ত রামপুরা, মালিবাগ, বিজয়নগর; রাজধানীর ধুলা ও ধোঁয়ার রাস্তায় তাকে প্রায়ই দেখা যেত। সামনে থাকা তরুণদের উদ্দেশে উঁচু গলায় ঘোষণা দিছ্নে—‘ভয় পাবেন না, আমরা ন্যায়বিচার চাই। সেই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরব না।’
ঘরে ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে যার পাশে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু হাদি রাজপথ বেছে নিয়েছিলেন। আন্দোলনের অগ্নিঝরা রাতে তিনি ঘুমিয়েছেন ফুটপাতে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে টেনে নিয়েছেন আরেকদিনের স্লোগান। তার চোখের সামনে ঘটেছে সহিংসতা, ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, গ্রেফতার আর নিখোঁজের মর্মান্তিক দৃশ্য। তবুও তিনি পিছু হটেননি।
যখন শান্তির দূত হয়ে ফিরেন শেকড়ে
‘২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি যখন নিজ জেলা ঝালকাঠিতে ফেরেন, তখন দেশের উত্তাল পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকেও ছুঁয়ে ফেলেছিল। সেখানে গিয়ে হাদি যেন নতুন রূপে দেখা দিলেন। হয়ে উঠলেন একজন শান্তির দূত। তিনি মহল্লা মহল্লায় গিয়ে তৈরি করলেন পাহারা দল। তার লক্ষ্য- হিন্দুদের মন্দির ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তার ভাষায়, ‘স্বাধীনতার চেতনা মানে সকল মানুষের নিরাপত্তা।’
শিক্ষাজীবনের শেকড় থেকে উঠে আসা দৃঢ়তা
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম। বাবা ছিলেন মাদরাসার শিক্ষক ও ইমাম। একজন সৎ, মমতাবান, সত্যনিষ্ঠ মানুষ। হাদি বলেন, তার ‘সত্য বলার সাহস’ বাবার কাছ থেকেই শেখা। স্কুল জীবনেই লেখালেখির প্রতি তার ঝোঁক, পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কারও। পরে নেছারাবাদ কামিল মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু মাদরাসার ছাত্র হওয়ায় তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিল নানা পক্ষপাত, তকমা, অপমান আর রাজনৈতিক নির্যাতনে ভরা। বারবার ‘শিবির’ বা ‘হেফাজত’ তকমা নিয়ে তাকে হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছিল। হয়তো তাই তার ভেতরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস তৈরি হয়েছিল গভীরভাবে।
ইনকিলাব মঞ্চ: এক ‘আইডিয়া’র জন্ম
২০২৪–এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে নয়, আন্দোলনের চেতনাকে সংগঠিত করতে চান। সেখান থেকেই ‘ইনকিলাব মঞ্চ’র জন্ম। এটি কোনো প্রচলিত রাজনীতির শক্তি নয়, বরং তার ভাষায়, ‘শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার সংগ্রামের সাংগঠনিক রূপ।’ তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা যেমন আছে, তেমনি আছে তরুণদের উল্লেখযোগ্য সমর্থন। কারণ হাদি দৃঢ়ভাবে বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডকে ছাড় দেব না।’
ওসমান হাদি এখন সবদলের আবেগ
শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলি চালানোর ঘটনাটি শুধু একটি রাজনৈতিক নেতার ওপর হামলা নয়, এটি যেন সারা দেশের বিবেককে নাড়া দেওয়া এক নিষ্ঠুর আঘাত। রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন পথচলা, আদর্শ বা মতাদর্শের বিভাজন এখানে যেন মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেছে। এক ব্যথা, এক উদ্বেগ, আর এক প্রার্থনায় সবাই মিলে দাঁড়িয়েছে হাদির সুস্থতার জন্য।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে, ‘হাদি আমাদের সবার অতি আপন ও স্নেহের মানুষ। ওসমান হাদির ওপর হামলা বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘ছাত্রদলসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান করছি—সরকারকে, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করুন, যাতে তারা দুষ্কৃতকারীকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে পারে।’
এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন,‘হাদি ভাইয়ের জুলাই স্পিরিট আমরা হৃদয়ে ধারণ করি। দলমত ভিন্ন হলেও জুলাই অবদানে আমরা সবাই এক।’
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘হে আসমান-জমিনের মালিক… হাদি ভাইকে রহমতের চাদরে আবৃত করুন।’ দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর আকুতিও হৃদয়ছোঁয়া, ‘আল্লাহ আমার ভাইকে বাঁচাইয়া রাখো।’
গণ-অধিকার পরিষদের নেতা রাশেদ খান বলেন, ‘হাদির মতো স্পষ্টবাদী, ভালো মানুষ আমাদের জন্য প্রয়োজন।’
যার গল্প কেবল শুরু হয়েছে
শরিফ ওসমান হাদির রাজনৈতিক যাত্রা লম্বা নয়, মাত্র কয়েক বছরের। কিন্তু ব্যক্তিত্ব, প্রতিবাদী অবস্থান ও জনস্বার্থে নির্ভীক ভূমিকার কারণে তিনি এমন এক নাম হয়ে উঠেছেন, যা নিয়ে এখন বহু আলোচনা। তার মতামত ও মনোনীত কর্মসূচিগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, গণতান্ত্রিক সংস্কার ও তথাকথিত অধিকারের ভিত্তিতে একটি ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র গঠন করতে চান।
হাদির গল্পটা শুধু রাজনীতির নয়, এটা এক তরুণের সাহস, স্বপ্ন, বিশ্বাস ও ত্যাগের গল্প। যার ঘরের দরজায় অপেক্ষা করছে একটি পরিবার, আর রাজপথে লাখো মানুষ।