ঢাকা: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত টেকসই উন্নয়নের পথে এগোলেও সবার জন্য মানসম্মত ও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এখনো একাধিক কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বাজেট সীমাবদ্ধতা থেকে শুরু করে জনবল সংকট ও দুর্বল তদারকি— সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থাই চাপের মুখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষ মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পায় না। অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছেই। গ্লোবাল হেলথ সিকিউরিটি ইনডেক্স-এ বাংলাদেশের অবস্থান ৯৫তম, যা প্রস্তুতি ও সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে।
শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর আস্থা জোরদার করা: গুণমান নিশ্চিতকরণের কৌশল’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি একে আজাদ খান। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআই’র সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী।
সেমিনারে দেশের স্বাস্থ্য খাতের প্রধান কয়েকটি সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হচ্ছে- বাজেট সংকট ও অদক্ষ বরাদ্দ; অপর্যাপ্ত অবকাঠামো; শহর-গ্রাম বৈষম্য প্রকট; দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা; মান ও আস্থার সংকট এবং চিকিৎসা ব্যয়ের লাগামহীন বৃদ্ধি।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও জিডিপি’র অনুপাতে তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নিচেই রয়েছে। চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে স্বাস্থ্য সেবা খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ৩১ হাজার ২২ কোটি টাকা। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২–২৩ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা।
গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাস্তব চিত্র অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয় সবচেয়ে কম। দেশে মাথাপিছু সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ১ হাজার ৭০ টাকা। ফলে নিজস্ব পকেট থেকে চিকিৎসা ব্যয় ২০২১ সালে বেড়ে ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০২০ সালে ছিল ৬৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা এখনও ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি ১ জন ডাক্তারের বিপরীতে রোগীর সংখ্যা ৮৩০ জন, প্রতি ডেন্টিস্টে ১১ হাজার ৫৩১ জন, এবং প্রতি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টে ৫৬ হাজার ৫৯৯ জন।
একই সঙ্গে হাসপাতাল অবকাঠামোতেও ঘাটতি স্পষ্ট। দেশে প্রতি ১ হাজার জনসংখ্যায় শয্যা সংখ্যা মাত্র ০.৮৮, যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, তবে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগও রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারী, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত মিলিয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ৪৬১টি (BNMC, ২০২৫), যা মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা আধুনিকায়নের লক্ষ্যে সরকার বাংলাদেশ ডিজিটাল হেলথ স্ট্র্যাটেজি ২০২৩–২০২৭ চালু করেছে, যার মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর সেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মানের বৈষম্য, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের ঘাটতি, অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ফার্মেসির বিস্তার, ভুল ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট, ভুয়া ওষুধ এবং দুর্বল তদারকি জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যখাতের ওপর জনগণের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান বলেন, একটি টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শুধু জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নেই নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মশক্তির উৎপাদনশীলতা এবং জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রয়োগ অপরিহার্য।
সেমিনারে বক্তারা স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়ানো, বরাদ্দের দক্ষ ব্যবহার, স্বাস্থ্য খাতে জনগণের আস্থা জোরদার করতে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা, শহর–গ্রাম বৈষম্য কমানো, কার্যকর নিয়ন্ত্রক কাঠামো গড়ে তোলা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।