Saturday 13 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার
বাংলাদেশ সরকারের নির্লিপ্ততায় সুযোগ নিচ্ছে অন্যদেশ

উজ্জল জিসান স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:২৬ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:৫০

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: জনশক্তি রফতানিতে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার মালয়েশিয়া। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনশক্তি রফতানির এই শ্রমবাজারটি সীমাহীন দুর্নীতির কারণে গতবছর থেকে বন্ধ আছে। জানা গেছে, ২০২৩ সালে সাড়ে ৩ লাখের বেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় যান। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন থেকে দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ওই বছর এক লাখের মতো কর্মী দেশটিতে যেতে পেরেছেন। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত জনশক্তি রফতানি হয়েছে মাত্র তিনশ’র মতো।

গত একবছরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দুই দেশের সরকার প্রধানের কার্যালয় থেকে শুরু করে উপদেষ্টা ও মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দফায় দফায় দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক ও সফরের পরও শ্রমবাজারটি খোলার বিষয়ে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি, আসেনি কোনো সফলতাও। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক ব্যর্থতার পাশাপাশি সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা এবং ঢালাও মামলার প্রভাবকে দায়ী করছেন শ্রমখাত সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

সরকার দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে এই শ্রমবাজার খুলতে না পারলে এবং মামলাবাজদের শাস্তি দিতে না পারলে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি। শ্রমখাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু এবং অপেক্ষায় থাকা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

নেপাল-ইন্দোনেশিয়া থেকেও পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের জন্য সৌদি আরবের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু, গতবছরের ৩১ মে থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। তবে, ‍গত জানুয়ারি থেকে ইন্দোনেশিয়া, নেপালসহ অন্যান্য সোর্স কান্ট্রি থেকে ফের শ্রমিক নিতে শুরু করে মালয়েশিয়া।

চলতি বছর ইন্দোনেশিয়া ও নেপাল থেকে ৪১ হাজার ৩৭৩ জন শ্রমিক নিয়েছে মালয়েশিয়া। এর মধ্যে নেপাল ২১ হাজার ১৮৩ জন ও ইন্দোনেশিয়া ২৯ হাজার ৯০০ শ্রমিক পাঠিয়েছে মালয়েশিয়ায়। এই দুটি দেশ থেকে আরও ৫০ হাজার শ্রমিক আগামী জানুয়ারির মধ্যে নেওয়া হবে। সেই প্রক্রিয়াও এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। গত একবছরে বাংলাদেশে আটকে পড়া ১৮ হাজার শ্রমিক থেকে মালয়েশিয়ায় গেছেন মাত্র ২৯০ জন।

এদিকে বাংলাদেশ বাদে অপর ১৪ সোর্স কান্ট্রি ২০২৫ সালে ১ লাখ ১৩ হাজার ২২২ জন শ্রমিক পাঠাতে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। এরমধ্যে নেপাল ৬০ হাজার, ইন্দোনেশিয়া ২২ হাজার ৬৮৫, ভারত ১২ হাজার ২৭ জন, পাকিস্তান ৭ হাজার ৪২৮ জন, ফিলিপাইন ৬ হাজার ২০৪ জন, মিয়ানমার ১ হাজার ৩৬০জন, থাইল্যান্ড ৬০৮ জন, শ্রীলঙ্কা ৩৭৭ জন ও ভিয়েতমান ৯২ জন। আর বাংলাদেশ থেকে চলতি বছর নিবন্ধন করেছেন মাত্র ১ হাজার ৮৫৩ জন।

সরকারের দ্বিপাক্ষিক সফরেও খোলেনি শ্রমবাজার

২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত কলিং ভিসা, নিয়োগানুমতি, বিএমইইটির ছাড়পত্রসহ যাবতীয় পক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরও প্রায় ১৮ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। গত বছরের ৪ অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বাংলাদেশ সফরের সময় বিষয়টি উত্থাপন করা হলে তিনি এসব শ্রমিককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এর পর বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল দুইবার মালয়েশিয়া সফর করেন।

এছাড়াও, কয়েক দফায় যৌথ ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। কিন্তু শ্রমবাজার খোলার কোন ধরনের সুফল আসেনি। গত বছরের মে মাসে আটকে পড়া শ্রমিকদের মালয়েশিয়া পাঠানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিস এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডকে (বোয়েসেল)। সরকারি প্রতিষ্ঠানটিও এসব শ্রমিক পাঠাতে ব্যার্থ হয়েছে।

ঢালাও মামলার বিরূপ প্রভাব

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে জিটুজি প্লাস চুক্তি অনুযায়ী ৪ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিক পাঠানো হয়। এই শ্রমিক পাঠাতে অর্থ পাচারের অভিযোগে বেশকয়েকটি মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব মামলায় সরাসরি অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার সঠিক তদন্ত না হওয়ায় এরই মধ্যে মালয়েশিয়া সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এসব ‘অপ্রমাণিত’ অভিযোগ প্রত্যাহার না করা হলে তারা বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেবে না।

ডেডলাইন ৩১ ডিসেম্বর

গত জুলাই থেকে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ছয় মাস হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৯০ জন শ্রমিক পাঠানো গেছে। আগামী ৩১ডিসেম্বরের মধ্যে আটকে পড়া অন্য শ্রমিকদের পাঠানো সম্ভব না হলে তাদেরও কপাল পুড়বে। এদিকে, আটকে পড়া শ্রমিকদের বিনা খরচে পাঠানোর কথা, তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা করে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে গত ৪ সেপ্টেম্বর জারি করা সার্কুলারে শ্রমিক পাঠানোর এই খরচ নির্ধারণ করা হয়।

জানা গেছে, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর জন্য সরকার অনুমোদিত খরচ ধরা হয়েছিল ৭৮ হাজার ৯০০ টাকা। বোয়েসেল তাদের বোর্ড সভায় অনুমোদন দেওয়ার মাধ্যমে এরই মধ্যে মালয়েশিয়ার একটি সংস্থাকে ভিসা কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা করে দিয়েছে। এই টাকা বাংলাদেশি ব্যবসায়ী আলতাফ খান ও মালয়েশিয়ান নাগরিক জসওয়ান সিং নামক ব্যক্তির মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। ওই টাকা দেওয়া হয়েছে অবৈধ প্রক্রিয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে।

এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা পরিশোধ করল এটা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, সরকারি সংস্থা বোয়েসেল অবৈধভাবে ভিসা ট্রেডিং ও মানবপাচারে জড়িত হয়ে পড়েছে। অথচ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা বা অন্যদের এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে বোয়েসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তারা এক লাখ টাকা রেখেছেন ভিসা কেনার ফি বাবদ। এরপরও শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় পাঠানো যায়নি।

জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ও তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা, কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং বোয়েসেল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

যা বলছে বায়রা

জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সিনিয়র সদস্য মোবারক উল্লাহ শিমুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যখন লোক পাঠাই তখন ভিসা ট্রেড করায় আমাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং ও মানবপাচারের অভিযোগে সিআইডি এবং দুদক মামলা করেছে। এখন সরকারি সংস্থাও একই কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে কারা? বোয়েসেল যে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা নিচ্ছে, সেখানে এক লাখ টাকা রাখা হয়েছে ভিসা কেনা বাবদ। কোনো বৈধ চ্যানেলে এসব অর্থ পাঠানোর তথ্য আমাদের জানা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুই দেশের সরকার প্রধান পর্যায়ের সভা করে আটকে পড়া ১৮ হাজার শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। যার কাজ নেয় বোয়েসেল। শুরুতে তারা ১৪ হাজার পরে ৭ হাজার ৮০০ জনকে মালয়েশিয়া পাঠানোর টার্গেট নির্ধারণ করে। কিন্তু বেঁধে দেওয়া ছয়মাসের আর মাত্র ১৫ দিন বাকি। কিন্তু শ্রমিক গেছে মাত্র ১৯০ জন। বাকি শ্রমিক আদৌ যেতে পারবে কি না তা নিশ্চিত নয়। অথচ ওইসব শ্রমিকের ডিমান্ড ভিসা সবই এনেছিল বেসরকারি এজেন্সি।’

বিজ্ঞাপন

আরো

উজ্জল জিসান - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর