চোখ হারিয়ে কী পেলাম: সিদ্দিকুর
২৩ জুলাই ২০১৮ ১৯:৫০
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘চোখ হারিয়েছি, সারাজীবনের জন্য সঙ্গী হয়েছে অন্ধকার পৃথিবী। কিন্তু এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ তো সেশন জট দূর করতে পারেনি। উল্টো ঝুলে রয়েছে অনেক শিক্ষার্থীর ভাগ্য। ধীর গতিতে পরীক্ষা নেওয়া ও সময়মতো ফল প্রকাশ না করায় এখনও অনেক শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। চোখ হারানোর তো একবছর পেরিয়ে গেল। চোখ হারিয়ে তাহলে কী পেলাম!’
একরাশ হতাশা আর আফসোস নিয়ে সারাবাংলা’র এই প্রতিবেদকের কাছে কথাগুলো বলছিলেন সিদ্দিকুর রহমান; সেশন জটের কবল থেকে রেহাই পেতে একবছর আগে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা ও রুটিন চেয়ে আন্দোলনে নেমে পুলিশের টিয়ারশেলে যিনি হারিয়েছিলেন এই পৃথিবী দেখার ক্ষমতা।
গত বছরের ২০ জুলাই পরীক্ষার রুটিন ও তারিখ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন শাহবাগে। সেখানে তাদের অবস্থান কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের টিয়ারশেলে গুরুতর আহত হন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান।
আহত অবস্থায় সিদ্দিকুরকে প্রথমে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ব্যর্থ হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে উন্নত চিকিৎসা জন্য চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে সিদ্দিকুরের চিকিৎসা হয়। কিন্তু সেই চিকিৎসাও তার চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে পারেনি। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গত বছরের ২ অক্টোর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ দেন।
সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলা’কে বলেন, সেদিন শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ লাঠিলার্জ করে, টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তাতে আমার দুই চোখ নষ্ট হয়ে যায়, আহত হয় অনেকে। গ্রেফতার করা হয় অনেক শিক্ষার্থীকে, মামলা হয় প্রায় ১২শ শিক্ষার্থীর নামে। এর মধ্যে সরকার আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়। সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু যে দাবিতে আমরা সেদিন দাঁড়িয়েছিলাম, তার তো কিছুই হলো না!’
সিদ্দিকুর জানান, গত বছরের ৭ ডিসেম্বর সম্মান তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষার পর দীর্ঘ আট মাসেও সেই পরীক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফল পাইনি। ‘তাহলে চোখ হারিয়ে আমি কী পেলাম!’— কার কাছে উত্তর চান, সেটাই হয়তো বুঝতে পারেন না সিদ্দিকুর।
সিদ্দিকুরের নিজের বিভাগের পরীক্ষার ফলও এখনও দেয়নি বলে জানান। ফলে তৃতীয় বর্ষেই ২০ থেকে ২২ মাস কেটে গিয়েছে। অথচ অনার্স শেষ না হলে ‘আজন্ম লালিত স্বপ্ন’ মার্স্টার্সেও ভর্তি হতে পারবেন না তিনি।
“চোখ হারানোর এক বছর হয়ে যাচ্ছে। কেউ যদি জানতে চান, এই এক বছরে আমার কষ্ট কী, তাহলে বলব- চোখের বিনিময়ে এখনও আমাদের শিক্ষা জীবন স্বাভাবিক হয়নি, এটাই আমার কষ্ট। আজকে আমার জীবন থেকে ‘লাইট’ চলে গেল, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জীবনটা এখনও স্বাভাবিক হলো না- এটাই আমাকে খুব বেশি পীড়া দেয়।”,— বলেন সিদ্দিকুর।
গত জুন মাসে এসেনসিয়াল ড্রাগসের চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে জানিয়ে সিদ্দিকুর বলেন, আগে তো দিনভিত্তিক বেতন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। তাই জীবনযাপনের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে। কয়েকদিন আগে পুরাতন বাসা ছেড়ে মাকে নিয়ে একটু ভালো বাসায় উঠেছি। শুরু থেকেই ইচ্ছে ছিল কম্পিউটারের কাজ শিখব। সে হিসেবেই আমি আগাচ্ছি, কম্পিউটারের বিভিন্ন কাজ এখন পারি।
কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সহযোগিতা পাচ্ছেন সিদ্দিকুর। সহকর্মীরাও তার কাজে খুশি। সিদ্দিকুর বলেন, এখন তো মাঝে মাঝে দুই থেকে তিন ঘণ্টা আমি একাই চালাই। কেউ না থাকলেও কাজ চালিয়ে নিতে পারি এখন। চোখ হারিয়ে যেন অন্যদের মুখাপেক্ষী না হতে হয়, সেই চ্যালেঞ্জ ছিল আমার সামনে। সেটা কিছুটা হলেও জয় করতে পেরেছি। তবে এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। আশা করি, সেই নির্ভরতাও ধীরে ধীরে কমে যাবে।
চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয় থেকে যখন চূড়ান্তভাবে জানতে পেরেছিলেন যে দৃষ্টি আর ফিরে পাবেন না, তখনও সিদ্দিকুর বলেছিলেন, নিজের চোখ হারানো নিয়ে তার কোনো আফসোস নেই। তার চোখের বিনিময়ে হলেও সহপাঠীদের শিক্ষাজীবন যেন নির্বিঘ্ন হয়, সেটাই ছিল তার চাওয়া।
সেই একই কথা ফের বলেন সিদ্দিকুর— ‘আমার জীবন নিয়ে আমি কিছু ভাবি না, এটা আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। তবে এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরে আসুক, সেটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’
সারাবাংলা/জেএ/টিআর