Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পেশাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকরা


২৭ আগস্ট ২০১৮ ১০:৩১

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: চিকিৎসকদের নিয়ে ভালো কিছু কিংবা তাদের অর্জন নিয়ে তো খুব কম প্রতিবেদনই দেখতে পাই। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসক নেই, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর মতো নেতিবাচক অনেক সংবাদ থাকে। এতে সব মিলিয়ে চিকিৎসকদের নিয়ে মানুষদের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে যেতে পারে। আমরা এসব নেতিবাচক চিত্রের অবসান চাই। আমরা চিকিৎসা পেশাকে মানুষের আস্থার জায়গাতে নিতে চাই। মানুষ যেন নির্দ্বিধায় চিকিৎসকদের ওপর ভরসা করতে পারেন, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

বিজ্ঞাপন

কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসক হওয়ার পথে থাকা একঝাঁক মেধাবী তরুণী বলছিলেন কথাগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সবগুলো মেডিকেল কলেজের সমাপনী পরীক্ষার মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের এই সাত নারী শিক্ষার্থী।

মেধাবী এই সাত মেডিকেল শিক্ষার্থী হলেন— নাবিলা বিনতে নূর, নুজহাত পরোমা, রাবেয়া বিনতে আক্তার, মদিনা মনোয়ারা, কামরুন নাহার অমি, নুজহাত সুলতানা মৌ ও শায়রা শারমিন। মেডিকেলের সমাপনী পরীক্ষার মেধাতালিকায় তাদের স্থান দ্বিতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম এবং যৌথভাবে দশম।

এ সাত মেধাবী মেডিকেল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার প্রতিবেদকের। তারা বলেন, ‘রোগীদের অভিযোগ নিয়ে যেমন সংবাদ হয়, তেমনি চিকিৎসকদের অভিযোগ বা অনুযোগ নিয়েও সংবাদ হওয়া দরকার। কারণ, এ বিষয় পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’ তবে রোগী-চিকিৎসক সর্ম্পকে নতুন মাত্রা দিতে কাজ করতে প্রত্যয়ী বলে জানান তারা।

চট্টগ্রামের মেয়ে নাবিলা বিনতে নূর। তিনি অর্জন করেছেন দশম স্থান। ফলাফল নিয়ে উচ্ছ্বসিত নাবিলা বলেন, ‘রেজাল্ট ঘোষণার সময় চট্টগ্রামেই ছিলাম। এক বন্ধু ফোন করে খবর দেয়। স্বাভাবিকভাবেই আমার গোটা পরিবার এই ফলে ভীষণ খুশি।’ এ ফলের জন্য নাবিলা তার মা-বাবা ও কলেজের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

বিজ্ঞাপন

নাবিলা বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ, সার্জারির তুহিন স্যার, গাইনি বিভাগ থেকে দিনা ম্যাম, সালমা রউফ ম্যামসহ প্রতিটি শিক্ষকর কাছে আমরা সব শিক্ষার্থীরা সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ।’

বাবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই চিকিৎসক হওয়ার প্রেরণা পেয়েছেন জানিয়ে নাবিলা জানান, ভবিষ্যতে সার্জারিতে বিশেষায়িত ডিগ্রি নিতে চান। কেন— জানতে চাইলেই হেসে উঠে বলেন, ‘সার্জারির পোশাকটা বেশি ভালো লাগে।’ পরে বললেন, সার্জারিতে ‘আলাদা কেমন যেন একটি বিষয় আছে’ বলেই এই বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চান তিনি।

মেধাতালিকায় নবম নুজহাত সুলতানা মৌয়ের কাছে তার এই ফল ‘টোটালি আনএক্সপেকটেড’। তিনি বলেন, ‘সবসমই আমার রোলটা একটু পেছনের দিকে। তার ওপর এই পরীক্ষা নিয়ে যতটা নার্ভাস ছিলাম, সারাজীবনে অন্য কোনো পরীক্ষায় তেমন হয়নি। সেই পরীক্ষাতেই প্রথম ১০ জনের মধ্যে স্থান পাওয়াটা সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত। খুব ভালো লাগছে যে মা-বাবার আশা পূরণ করতে পেরেছি।’ মেডিকেল অ্যান্ডোক্রাইনলোজিতে ‘ফ্যাসিনেশন’ রয়েছেন বলে জানান তিনি।

চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এখন ইন্টার্নশিপ করছেন এই সাত শিক্ষার্থী। তাদের একজন শায়রা শারমিন। তিনি বলেন, “ইন্টার্নশিপের শুরুর দিকে যে রুমটাতে রোগী দেখি, সেখানে একজন রোগী এসেছিলেন। তাকে দেখার পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘মা, আপনার কথা শুনলে রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায়, আপনি সারাজীবন এমনই থাকবেন।’ সেদিনের কথাটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। এর সঙ্গে কোনোকিছুর তুলনা হয় না।”

আর কিছুদিন পরই পুরোদস্তুর চিকিৎসক হয়ে উঠবেন এই শিক্ষার্থীরা। তাদের সামনে কোনো চিকিৎসক আইডল রয়েছে কি না— জানতে চাইলে সবাই সমস্বরে বলে ওঠেন, আজাদ স্যারের (ঢাকা মেডিকেল কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ) কথা। তারা সবাই তার মতো হতে চান। তাদের ভাষ্য, তিনি অন্যরকম মানুষ। তার সঙ্গে কথা বললে যেকোনো মানুষের অসুস্থতা অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। আমাদের অনেক বড় পাওয়া যে আজাদ স্যারের মতো একজন মানুষকে আমরা অধ্যক্ষ হিসেবে, গাইড হিসেবে এবং সর্বোপরি একজন অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি।

মেধাতালিকায় রাবেয়া বিনতে আক্তারের স্থান চতুর্থ। সিরাজগঞ্জের এই মেয়ের ইচ্ছা ভবিষ্যতে গাইনি বিষেশজ্ঞ হওয়া। কারণ হিসেবে বলেন, ‘পরিবারে নারী চিকিৎসক আমিই প্রথম। পরিবারে অন্য যারা নারী রয়েছেন, তাদের সবার ইচ্ছা আমি গাইনোকলজি নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ব।’

চিকিৎসক হিসেবে কোন কাজটি ভবিষ্যতে করতে চান— জানতে চাইলে মেধাতালিকার প্রথম দশে থাকা আরেক মেডিকেল শিক্ষার্থী কামরুন নাহার অমি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসকদের সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকরা একজন মানুষকে বাঁচাতে কতটা চেষ্টা করেন, সেটা কেবল চিকিৎসকরাই জানেন। আমাদের এই সৎ প্রচেষ্টাটুকু মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই।’

আরেক হবু চিকিৎসক নাবিলা বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য অনেকে ভারতে চলে যান। আমি চাই, ভবিষ্যতে দেশেই তারা সেরা চিকিৎসাটা পাবেন এবং দেশে থেকেই চিকিৎসা নেবেন।’

যশোরের মেয়ে কামরুন্নাহার অমি পরিবারের ‘স্বপ্নের চাপে’ই এসেছিলেন মেডিকেল পড়তে। তিনি বলেন, ‘নিজে বোঝার আগেই বাসায় দেখতাম সবাই বলত, ডাক্তার হতে হবে। বড় ভাই বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর সবার প্রত্যাশার চাপ আমার ওপরেই পড়ে। তবে চিকিৎসকদের সাদা অ্যাপ্রোনও আমার খুব ভালো লাগত। সেই ভালো লাগাটা এখন ভালোবাসা হয়ে গেছে। পরিবারের স্বপ্নও পূরণ হয়েছে।’

সমাপনী পরীক্ষার মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া নুজহাত পরোমা ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী। তিনি বলছেন, ‘আমাদের তো মানুষের শরীর নিয়ে কাজ করতে হয়। একটা মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে ঠিক করা যায়। কিন্তু মানুষের শরীর তো তেমন নয়। তাই একজন রোগীর কিছু হয়ে গেলে সেই দায়ভার তো আমাদেরই। এই কথাটা মাথায় গেঁথে গিয়েছে। বুঝতে পারি, এটা মহৎ হলেও খুব কঠিন কাজ। সেই চ্যালেঞ্জ মেনেই কাজ করতে হবে।’ মেডিকেল কলেজে প্রথম বর্ষ থেকে পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত যা কিছু শিখেছেন, সেগুলোকেই জীবনের অন্যতম শিক্ষা বলে মনে করছেন তিনি।

কীভাবে একজন ভালো চিকিৎসক হয়ে উঠতে হবে, কীভাবে একজন রোগীকে কাউন্সেলিং করতে হবে— মোট কথা চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে এখন শিখছেন বলে জানালেন আরেক শিক্ষার্থী পরোমা। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও ইন্টার্ন করছি, এখনও শিখছি। অনেক পথ বাকি। তবে আমরা সবাই মিলে ভবিষ্যতে এই পেশাকে অনন্য একটি উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।’

নড়াইলের মেয় মদিনা মনোয়ারা ষষ্ঠ স্থান পেয়েছেন মেধাতালিকায়। ঢাকায় পরিবারের সঙ্গেই থাকেন। তিনি বলেন, ‘প্লেস করব— এটা ভাবতেই পারিনি। টিচারদের কাছে কৃতজ্ঞ, তারা হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়েছেন। তাদের সহযোগিতা ছাড়া এত দূর আসা সম্ভব হতো না।’

নতুন প্রজন্মের এই চিকিৎসকদের সবার মাথাতেই একটি বিষয় কাজ করছে। তা হলো— চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর সম্পর্কে নেতিবাচক যে চিত্র বিদ্যমান, তা পাল্টে ফেলতে চান তারা। পরোমা যেমন বললেন, চিকিৎসকদের যেমন ধৈর্য নিয়ে রোগী ও স্বজনদের কাউন্সেলিং করতে হবে, তেমনি বিপরীত পক্ষকেও ধৈর্য নিয়ে শুনতে হবে। পরস্পরকে পরস্পরের জায়গা থেকে পরিস্থিতি ভাবতে শিখতে হবে।

তবে আমাদের দেশে রোগীর অনুপাতে চিকিৎসকদের সংখ্যা কত এবং এই অনুপাতে একজন চিকিৎসকের পক্ষে কতটা ভালো চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব— সে বিষয়েও সবাইকে একটু ভাবতে অনুরোধ করলেন মদিনা মনোয়ারা।

নাবিলা বলছেন, আমরা যখন তৃতীয় বর্ষের ক্লাস মাত্র শুরু করেছি, তখনই টিচাররা বলেছেন— রোগীদের সম্মান করতে শেখো। রোগী মানে রোগী, সেখানে কোনো শ্রেণিভেদ নেই। রোগীদের মা-বাবা ডাকতে শেখানো হয়েছে আমাদের, যেন রোগীরা আপন হতে পারেন। আমরা নিশ্চয় সেই শিক্ষাকে ধরে রেখেই চলব।

মেডিকেল ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন শায়রা শারমিন। কিন্তু এই শায়রাই যৌথভাবে দশম স্থান অর্জন করেছেন নাবিলার সঙ্গে। শায়রা বলেন, ‘আমি মেডিকেলে নিজে আসতে চাইনি। কিন্তু বাবার চাপে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি, তারপর সুযোগ পেয়ে ভর্তি। কিন্তু লেখাপড়ার চাপ দেখে ছেড়ে দিতে মন চাইত। একসময় মানিয়ে নিতে হয়েছে। কিন্তু এখন এই পেশাটির প্রতি সম্মান বেড়ে গেছে।’

কথা বলে ফিরে আসার সময় রাবেয়া বিনতে আক্তার বললেন, ‘ফল পাওয়ার পর অনেকেই যোগাযোগ করেছেন, ছবি তুলেছেন। শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে আমাদের সম্মান জানিয়েছেন— সে এক স্মরণীয় মুহূর্ত। কিন্তু আমরা এতটা যোগ্য তো এখনও হয়ে উঠতে পারিনি। তবে সবার কাছে দোয়া চাই, তেমন যোগ্য যেন আমরা হয়ে উঠতে পারি।’

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর