অগ্রগতি থাকলেও নবজাতক মৃত্যুতে শীর্ষ ১০ দেশের একটি বাংলাদেশ
২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৩০
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিশুর মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, অর্থাৎ নবজাতক অবস্থায়। সবচেয়ে বেশি নবজাতকের মৃত্যু হয়— এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। অথচ শিশু জন্মের সময় মানসম্মত মাতৃসেবা ও অসুস্থ নবজাতকের বিশেষ সেবার ব্যবস্থা করতে পারলেই অনেক মা ও শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার গত কয়েক দশকে অনেকাংশে কমে এলেও নবজাতকের মৃত্যুহার এখনও কমেনি।
জাতিসংঘের শিশু ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ (এমডিজি) অর্জন করেছে এবং বিশেষ করে পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনার অগ্রগতি সে তুলনায় কম। অথচ নবজাতক মৃত্যুর ৯০ শতাংশ ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালে দেশে ২ লাখ ৪১ হাজার নবজাতকের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে সে সংখ্যা ৬২ হাজারে নেমে আসে। তারপরও বিশ্বের যে ১০টি দেশে সবচেয়ে বেশি নবজাতকের মৃত্যু হয়, বাংলাদেশ এখনও সেই তালিকায় রয়ে গেছে।
ইউনিসেফ জানায়, বাংলাদেশে ৮৮ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু হয় মূলত তিনটি প্রতিরোধযোগ্য কারণে। প্রশিক্ষিত ধাত্রী, পরিষ্কার পানি ও জীবাণুনাশকের ব্যবহার; জন্মের প্রথম ঘণ্টাতেই শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং শিশুকে মায়ের সান্নিধ্যে রাখা ও ভালো পুষ্টিপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরির মাধ্যমে এসব মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়। আবার জন্মের তিন দিনের মধ্যে গোসল করানো উচিত নয়। এতে নবজাতকের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মনীষা ব্যানার্জী সারাবাংলা’কে বলেন, জন্মের পর থেকেই মায়ের সান্নিধ্যে রাখলে শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে, ওজন বাড়ে, শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি হয় এবং শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
অধ্যাপক ডা. মনীষা ব্যানার্জী নবজাতকের বিপদের চিহ্ন উল্লেখ করতে গিয়ে শরীর নেতিয়ে পড়া, খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, জ্বর-খিঁচুনি, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত নেওয়া এবং বুকের খাঁচা দেবে যাওয়ার কথা বলেন। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতকের শরীর ভালো করে শুকনো করে মুছে নেওয়া এবং জন্মের পর প্রথম ছয় মাস কেবল মায়ের বুকের দুধ পান করানোর মাধ্যমে শিশুর নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায় বলেও জানান তিনি।
গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাজী রকীব উল ইসলাম নবজাতক মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রি-ম্যাচুরিটি (মাতৃগর্ভে পূর্ণ বিকাশ না হওয়া), কম ওজন, জন্মগত ত্রুটি, খিঁচুনি, বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন ও বার্থ ইনজুরির (জন্মদানের সময় দুর্ঘটনা) কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, গর্ভধারণের আগ থেকে সন্তানের জন্মের পর মায়ের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা করতে হবে। তাহলেই শিশুমৃত্যু হার রোধ করার হার অনেক বেড়ে যাবে। পরিণত বয়সে, বিশেষ করে ২০ বছরের আগে কোনো নারী গর্ভধারণ করবে না এবং ৩০ বছরের মধ্যে প্রথম সন্তান না নেওয়াটাই নারী স্বাস্থ্যের অন্যতম জরুরি অংশ। এর মাধ্যমেও নবজাতক মৃত্যু রোধ হয়।
সারাবাংলা’কে এই শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ করে পুষ্টির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে, গর্ভধারণ সময়ে নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থেকে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে, ‘সেফ অ্যান্ড ক্লিন ডেলিভারি’ একজন মায়ের প্রসব ও সুস্থ শিশুর জন্মানোর অন্যতম পূর্বশর্ত বলেও মন্তব্য করেন ডা. রকীব উল ইসলাম। একইসঙ্গে ‘ইমিডিয়েট কেয়ার আফটার ডেলিভারি’ বা জন্মের পরপরই পরিচর্যার আওতায় আসাকেও নবজাতকের মৃত্যু প্রতিরোধের অন্যতম উপায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপ-উপাচার্য ও নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ নবজাতক মৃত্যুর কারণ হিসেবে অপরিণত বয়সে জন্ম, জন্মের সময় জটিলতা ও বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের কথাই জানালেন। তিনি বলেন, এই তিন কারণেই জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে।
অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যাচ্ছে, এমন নবজাতকের ৭৩ শতাংশ মারা যাচ্ছে বাড়িতে প্রসবের সময়। বাড়িতে প্রসবকালে জটিলতা তৈরি হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার মতো বাড়িতে না থাকাতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
ইউনিসেফের হেলথ ম্যানেজার জিয়াউল মতিন সারাবাংলা’কে বলেন, কেবল সেবার মান নিশ্চিত করেই নবজাতক মৃত্যুহার রোধ করা যায়। কারণ, বেশিরভাগ শিশুর মৃত্যু হয় প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতার কারণে। তাই হবু মায়ের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে প্রসবের সময়ে মায়েদের সেবা কেন্দ্রে আসা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই নবজাতক মৃত্যুহার কমিয়ে আনা যাবে।
সারাবাংলা/জেএ/টিআর