বিনাশ হইয়া গেলো সব… বিলীন হইয়া গেলো
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৮:৩৭
।। মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক ।।
নড়িয়া (শরিয়তপুর) থেকে ফিরে: পায়ের তলায় পাকা রাস্তাটিতে গভীর দু’টি ফাটল ধরেছে। তার একটি ফাটল একেবারে নদীর কোল ঘেঁষে। অন্যটি কিছুটা দূরে। প্রথম ফাটলটি এড়িয়ে, অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে দ্বিতীয় ফাটলের কিছুটা ভেতরে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে শূন্যদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন জবেদ আলী বন্দুকসি। বিকেলের আকাশে মেঘ জমেছে, দিনের যেকোনো সময়ের চেয়ে পদ্মা তখন বেশি রুদ্র। জবেদ আলী পদ্মার এর চেয়েও ভয়ংকর রূপ দেখেছেন, কিন্তু এতটা আগ্রাসী হতে দেখেননি। মাত্র কয়েকটি দিনের ব্যবধানে এমন করে গ্রামের পর গ্রাম হারিয়ে যেতেও আর কখনোই দেখেননি তিনি।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চরের শেরআলীর ডাঙ্গির এই পাকা রাস্তাটি ছিলো টানা আড়াই মাইল। যার প্রায় পুরোটিই এখন নদীর গর্ভে। কেবল সড়ক নয়, সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে কলমীর চর, ইশ্বরকাঠী, ভেদিকান্দী, পাচগার ডাঙ্গির মতো জনপদগুলো।
নদীর বুকে অনেক দূরে আঙুল দেখিয়ে জবেদ আলী বললেন, ওই এলাকায় সব ছিল। জমি-জিরেত, হাল-বলদ, ক্ষেত-খামার। তাতে ধান-পাট যেমন ফলত, ধূলোট ফসলেরও ছিলও দারুণ ফলন। এই এলাকার মানুষগুলো কষ্ট ছিল না। তাদের ছিল দালান বাড়ি। গেরস্থ বাড়িগুলোর সবাই সুখে শান্তিতেই ছিলেন। তার সবটাই এখন বিলীন হয়ে গেছে।
আশপাশে ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন আরও কয়েকজন। তাদেরই একজন সালাউদ্দিন ছইয়াল। তিনি বলেন, এই সড়কটি আড়াই মাইল পর্যন্ত যাওয়ার পর গ্রাম ছিল আড়াআড়ি। তাতে যে কত শত ঘরবাড়ি ছিল, তার আর হিসাব নাই।
বন্দুকসি তার সঙ্গে কথা মিলিয়ে বলেন, সেই গ্রামের আরও পরে ছিল পদ্মার ঘাট। সেই ঘাট থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়ে তারা ঢাকা যেতেন।
বিশাল নদীর ওপরটা এখন খালি চোখে দেখাও যায় না। বন্দুকসি সে দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞতার চোখ দিয়ে হিসেব কষে বললেন, নদী এখন এখানে ২০-২২ মাইলের কম হবে না। অথচ এখানে নদী ছিল অনেক ছোট। তার হিসাবে, এই নদী এখানে ১০-১২ মাইলের বেশি প্রশস্ত ছিল না। তার সে কথায় সায় দিলেন রশীদ মোল্লা, আবদুল মান্নান খালাসি, আলাউদ্দিন খালাসিসহ অন্যরাও। তাদের প্রত্যেকেই ষাট-সত্তুরের কোটায়।
আলাউদ্দিন খালাসির কণ্ঠে ক্ষোভ, ‘রোহিঙ্গাদেরও একটা দাম আছে। তাদের জন্য বিদেশ থেকে সাহায্য আসে। আমরা তো কিছুই পাই না।’
তার সেই কষ্টের সঙ্গী হন অন্যরাও। আলাউদ্দিন বলেন, একসময় সব ছিল। নিজের জমি-জিরাত। এখন অন্যের কাজ করে পেট চালাতে হয়। এখন আর পায়ের তলায় মাটি নাই।
ভিড়ের মধ্যে অনেকটা আগেই এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন রশীদ মোল্লা। তার বাড়িটি পদ্মার ৬০-৭০ গজের ভেতরেই। জানালেন, এরই মধ্যে বাড়ির গাছপালা বিক্রি করে দিয়েছেন। ফরিয়ারা মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পানির দরে এগুলো কিনছে। যাদের টিন-কাঠের বাড়ি, তারা খুলে নিয়ে যেতে পারছে… কিন্তু যারা দালানকোঠা বানিয়েছিলেন, তাদের কিছুই করার নেই। যেসব বাড়ি তৈরি করতে ৮-১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ হাজার টাকায়।
জবেদ আলী বন্দুকসি অন্য খবরও রাখেন। তার ধারণা, পদ্মা সেতুর কারণে এই ভাঙন। তিনি নাকি শুনেছেন, পদ্মা সেতু তৈরির আগেই ইঞ্জিনিয়াররা এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন, ব্রিজ হতে হলে আগে দক্ষিণাংশে বেড়িবাঁধ দিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সেটা করা হয়নি। আর সে কারণেই এই অঞ্চলের মানুষের আজ এত দুঃখ।
‘ওদিকে ব্রিজ হইলো, আর এদিকে সবকিছু বিনাশ হইয়া গেলো গা… বিলীন হইয়া গেলো,’— জবেদ আলী বন্দুকসির কণ্ঠে আফসোস। তিনি বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়াররা আগেই কইছিল, ব্রিজ হবে, কিন্তু দক্ষিণ পরগনা থাকবে না। ব্রিজ করা শুরু হওয়ার পরই নদীর ভাঙন শুরু হইলো।’
তার এ বক্তব্যে একমত অন্যরাও। ‘ব্রিজ করা শুরুর তনেই তো এই নদী ভাঙতে শুরু করেছে, এই হইলো মূল তত্ত্ব’, বন্দুকসির কথায় সুর মিলিয়ে বললেন সালাউদ্দিন ছইয়াল।
নড়িয়া অংশে পদ্মার এই রুদ্র চেহারা, আর বিধ্বংসী আচরণের পেছনে পদ্মা সেতুর কতটা ভূমিকা রয়েছে, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আরও গবেষণার বিষয়। তবে গোটা পদ্মাপাড়ের মানুষগুলো একটি বেড়িবাঁধের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন অনেক আগে থেকেই। সরকারের পরিকল্পনাবিদরা তা জানেন। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাও জানেন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর তাদের কোনো ক্ষোভ নেই। তারা জানেন, এরই মধ্যে এই বেড়িবাঁধের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার কাজ শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কেন দেরি হচ্ছে, তা জানা নেই এই ভাঙনকবলিত মানুষগুলোর। তারা শুধু একটি কথাই বলছেন, গত জানুয়ারিতে পাস হওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ যদি ফেব্রুয়ারি-মার্চেও শুরু করা যেত, তাহলে জনপদগুলো উজাড় হতো না, বিলীন হয়ে যেত না পদ্মার গর্ভে।
আর জবেদ আলী বন্দুকসির বুকের গভীর থেকে উচ্চারিত হতো না— সবকিছু বিনাশ হইয়া গেলো গা… বিলীন হইয়া গেলো।
হঠাৎই কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘এই ফাটল তো আরও বড় হইয়া গেছে।’ সে কথায় সবাই ফাটলের অংশ থেকে দূরে সরে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বন্দুকসি বললেন, তলা থেকে এখন অনেক দূর পর্যন্ত আগেই ভেঙে গেছে। ওপরের দিকটা যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে।
কাশেম খালাসিকে দেখা গেলো পাশেই স্লুইস গেটের ভাঙা একটি অংশের ওপর তিনি দাঁড়িয়ে, উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন পদ্মার দিকে। জবেদ আলী বন্দুকসিকে ঘিরে জটলাটা তখনও বাড়ছিল…। দুই হাত পেছনে বাঁধা, রশীদ মোল্লা ফাটলটিকে আরও গভীরভাবে একটু দেখে নিয়ে জটলা থেকে বের হয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। এ ফাটলের অংশটুকু ভেঙে পড়লে তার বাড়ির দিকে পদ্মা আরও চার গজ এগিয়ে যাবে…।
সারবাংলা/এমএম