পদ্মা গিলে খাচ্ছে হাসপাতাল
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:৪৪
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
নড়িয়া (শরীয়তপুর) থেকে ফিরে: রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১টা ১৮ মিনিট। নড়িয়ার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে মোটা একটি দড়ি ব্যারিকেড দেওয়া। দড়ির ওপারে মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেউ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন, উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন কেউ কেউ দড়ির এপারে, কেউ হাত তুলে ধরেছেন মোনাজাত- সেখানে একটুখানি সবুজ জায়গার পরেই পদ্মা, প্রমত্তা পদ্মা।
পদ্মা কেমন করে হাসপাতালকে গ্রাস করবে সে দৃশ্য দেখতেই এখানে মানুষের ভিড়, সঙ্গে আছেন সংবাদকর্মীরাও।
সাধারণ মানুষ যখন ভাঙনের দৃশ্য দেখার জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন ভেতরে চলছে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠক। আলোচনা চলছে কী করে হাসপাতালের রোগীদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায়, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কোথায় স্থানান্তর করতে হবে?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন কাছে এগিয়ে আসে। সবুজ মাঠের শেষ জায়গাটুকুতে একটি কৃষ্ণচূড়া আর হরিতকি গাছ একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ছিল। আরেক পাশে ছিল একটি ইলেকট্রিক খুঁটি। দুপুর ২টা ১৮ মিনিটের দিকে মানুষের মধ্যে আহাজারি বেড়ে গেল, ইলেক্ট্রিক খুঁটিটি ডান দিকে-পদ্মাতে হেলে পরতে শুরু করেছে, খুঁটির নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে একসময় খুঁটিটি পদ্মায় মিলে গেল। তবে সবাই যখন বিস্ফোরিত চোখে ইলেক্ট্রিক খুঁটির দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক তখনই ডান দিকে সেই কৃষ্ণচূড়া আর হরিতকি গাছের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে পদ্মার পানি, কাঁপতে থাকে মাটির নিচ, দেবে যেতে থাকে মাটি, চিৎকার-আহাজারির ভেতরেই চোখের পলকে কৃষ্ণচূড়া আর হরিতকি গাছটি পড়ে গেল পদ্মায়-নিমিষেই মিলিয়ে গেল পদ্মার বুকে-স্থানীয়দের ভাষায় একটু সময় পাওয়া গেল না, পদ্মা যেন বাঘ-শিকারের অপেক্ষায় ছিল, হরিণকে হাতের নাগালে পেয়েই টুপ করে গিলে ফেলল।
এমনই এক সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছে পদ্মা, প্রমত্তা পদ্মা। প্রমত্তা পদ্মার সর্বনাশা ঢেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। বাড়ি-ঘর, মানুষ, মসজিদ-মন্দির, হাসপাতাল কেউ রক্ষা পাচ্ছে না।
পদ্মার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে গত কয়েকমাসে। হাসপাতালের সামনে ওষুধের ২৫টি দোকান এরইমধ্যে পদ্মায় বিলীন হয়েছে।
রোববার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবনে ফাটল ধরে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কমপাউন্ডের ভেতের থাকা গ্যারেজ, মসজিদের সামনের অংশ, সীমানাপ্রাচীর ও প্রবেশফটক বিলীন হয়েছে পদ্মার পেটে।
১০ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল ভবনের কী অবস্থা জানতে চাইলে স্থানীয় সাংবাদিক ইসরাফিল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল আপনারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সে জায়গাটুকু আজ পদ্মায় চলে গেছে। হাসপাতালের নতুন ভবনের ২৫ শতাংশ পদ্মার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও ভেঙে পড়েছে। মসজিদের ৭৫ শতাংশ অংশ ভেঙে গেছে। এই মুহূর্তে (দুপুর দেড়টা) পুরনো ভবনের ২৫ মিটার দূরে রয়েছে পদ্মা।’
হাসপাতাল সূত্র থেকে জানা যায়, ভাঙনের কারণে ৫০ শয্যার এই স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সের ১২টি ভবন ঝুঁকিতে রয়েছে। তার ভেতরে আবাসিক ভবন ৩৫ হাজার টাকা নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। হাসপাতালের রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে চিকিৎসক ও কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদেরও।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৬৮ সালে নড়িয়া উপজেলা সদরের চার কিলোমিটার দূরে মুলফৎগঞ্জ বাজারে ৩০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তীতে সেখানে আরও ২০ শয্যা বাড়িয়ে হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এখানে হাসপাতাল মূল ভবনসহ ১২টি ভবন রয়েছে।
এরমধ্যে দুটি তিনতলা ভবনে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগ চালু ছিল। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকায় ৩ আগস্ট ওই ভবন থেকে রোগীদের সরিয়ে হাসপাতাল চত্বরের পেছনের দিকে একটি আবাসিক ভবনে ছোট পরিসরে ১০ শয্যার জরুরি চিকিৎসাসেবা চালু রাখা হয়। আর ভাঙন যতই কাছে আসছিল ততই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল হাসপাতালে চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। সরিয়ে নেওয়া হয় পরিবার সদস্যদের। একদম জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রোগীরাও হাসপাতাল ছেড়ে যায়।
গত কয়েকমাস আগে এই হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন দেওয়ান সাবরিনা মাসুক।
ডা. সাবরিনা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১৫০ থেকে ২০০ জনের মতো রোগী আসতেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকতেন প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জনের মতো।’
ডা. সাবরিনা বলেন, ‘কেবল নড়িয়া নয়, আশেপাশের অন্য অনেক থানা থেকে, জাজিরার শেষ ভাগের মানুষও এই হাসপাতালের চিকিৎসা নিতেন। এসব এলাকার মানুষ কীভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এতে-সেটা বলার মতো কিংবা বোঝানোর মতো ক্ষমতা আমার নেই-পুরো এলাকাতে এর প্রভাব পড়বে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত দেড় দুই বছর ধরে নদী ভাঙন নিয়ে স্থানীয় মানুষেরা সোচ্চার সোচ্চার থাকলেও এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তখন যদি পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে আরেকটা হাসপাতালের স্ট্রাকচার গড়ে উঠত। তাতে পরিকল্পিতভাবে অনেক কিছু করা যেত। এখন যেটা হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে রোগীদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, এটা নিয়ে আরও আগেই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল বলে মনে করি। নদী ভাঙনের বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল, তাহলে তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি?’
নড়িয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘হাসপাতালের কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চালু রাখা হয়েছে। এরইমধ্যে যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র ভোজেশ্বর, পণ্ডিতসার ও নড়িয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
গতকাল ৯ সেপ্টেম্বর দেখে আসা ভাঙন আরও এগিয়েছে, সেই কৃষ্ণচূড়া-হরিতকি গাছ তো গেছেই গেছে সেই সবুজ মাঠের জায়গাটুকুও, ভাঙন এগুচ্ছে, এগুচ্ছে সর্বনাশা পদ্মা।
নড়িয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন যে অবস্থা চলছে তা ভয়াবহ জরুরি অবস্থা বলা হচ্ছে। শুধু জরুরি অবস্থা বললে ভুল হবে। আমরা সকলে ভয়াবহ আতঙ্ক ও আশঙ্কায় আছি। এই মুহূর্তে এই ভবনগুলো রক্ষা মূল বিষয়। হাসপাতালকে চালু রাখা, রোগীদের অন্য জায়গায় নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখাকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি।’
‘ভবনগুলোকে নদীগর্ভে বিলীন হতে না দিয়ে নিলামে তুলে সরকারের ফান্ডে কিছু টাকা রিফান্ড করা হবে। পরবর্তীতে নদী রক্ষাবাঁধ, হাসপাতালের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বড় বিষয় এ মুহূর্তে স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখা।’
‘হাসপাতাল ভবনগুলো নিলাম হওয়ার কথা ছিল এবং স্থানীয় মানুষের বাধার কারণে নিলাম হয়নি’ জানালে তিনি বলেন, ‘এই হাসপাতাল চালু হয়েছে স্থানীয়দের ব্যক্তিগত জমিতে। হাসপাতালের সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িত। কিন্তু আবেগের সঙ্গে রিজেনেবল সিদ্ধান্ত যায় না। জরুরি পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অন্য কোথাও না কোথাও তো শিফট হতে হবে। সেটা আজ এবং কালকের মধ্যে করতে হবে তা না হলে ভবনগুলো নদীগর্ভে চলে যাবে।’
শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন ডা. খলিলুর রহমান বলেন, ‘ত্বরিত গতিতে হাসপাতালে থাকা রোগীদের আমরা অন্যান্য সাবসেন্টারগুলোতে স্থানান্তর করা হয়েছে। এখান বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসক-নার্সরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালের মূল ভবনটি নোটিশ দিয়ে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। হাসপাতাল চিকিৎসক-কর্মচারীদের অ্যালোকেশন বাতিল করা হয়েছে। শুধু যারা জরুরি বিভাগে কর্মরত আছেন তাদেরকে রাখা হয়েছে।’
হাসাপাতাল ভবনগুলোর নিলাম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে ভবনগুলো হুমকির সম্মুখীন সেগুলো নিলামে তোলা হচ্ছে।’
ছবি তুলেছেন সারাবাংলার সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট হাবিবুর রহমান
সারাবাংলা/জেএ/একে