‘আগে ছিলাম ক্লিনিক মালিক, এখন গাছ ঠেলি’
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৫৫
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
নড়িয়া (শরীয়তপুর) থেকে ফিরে: শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দুপুর দেড়টা। কমপ্লেক্সে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভ্যানে করে গাছের কেটে ফেলা নানা অংশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাইরে। প্রশাসন ভবনের ভেতরে সে মুহূর্তে অ্যাসিল্যান্ড অফিসা, সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্টরা বৈঠক করছেন, আর কমপ্লেক্সের একেবারে পেছনে মানুষজন জড়ো হয়েছেন একটি বেঁধে রাখা দড়ির এপারে, দড়ির ওপারে তখন সর্বনাশা পদ্মা এগিয়ে আসছে হাসপাতালকে গ্রাস করতে।
হাসপাতালের ভেততে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে ভ্যানের সঙ্গে থাকা একজনকে চোখে পড়ে আলাদা করে। মেরুন রঙের টি-শার্ট পরা তরুণটির চোখে-মুখে ক্লান্তি যতোটা না দেখা যায়, তার চেয়ে বেশি চোখে পড়বে বিষন্নতা, সব হারানোর দুঃখবোধ আর নীরব কান্না।
https://youtu.be/w1mZAswtceA?t=1
মাটি থেকে গাছের গুড়ি ভ্যানে তুলছিলেন তিনি অন্য সবার সঙ্গে, তারপর ভ্যান ঠেলতে ঠেলতে স্বগোক্তি করলেন ‘আগে ছিলাম ক্লিনিক মালিক এখন গাছ ঠেলি’।
কথাটা কানে যেতেই দাঁড়ালাম, কথা বলতে চাইতেই বললেন, সব নিয়ে গিয়েছে পদ্মা। কিছুই বাকি রাখেনি, কেবল জীবনটাই আছে। সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের, আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। জানালেন তার নাম সোহেল দেওয়ান। নড়িয়ার মূলফুৎগঞ্জ বাজারে থাকা দেওয়ান ক্লিনিকের মালিক।
গত ২ সেপ্টেম্বর দেওয়ান ক্লিনিক পদ্মায় মিশে গেছে, বিলীন গেয়ে গেছে। বিলীন হয়েছে দেওয়ান ক্লিনিকের পাশে থাকা দেওয়ান রওশন আরা প্লাজা, পাশের রাস্তা এবং তাদের বাড়িসহ পুরো এলাকা। আকাশের দিকে চোখ রেখে সোহেল বলেন, আমাদের বাড়িতে আগে আত্মীয়স্বজনসহ অন্তত একশ মানুষ খেতে পারতো, থাকতে পারতো, এখন আমার মাকেই রেখে এসছি আত্মীয়ের বাড়িতে, আমি থাকি একটা গ্যারেজে আর বাবাকে রেখেছি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটা কক্ষে-যে কক্ষটিকে পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাকে এখান থেকে সরানো যাচ্ছে না।
সোহেল দেওয়ান জানান, ২০০২ সালে তার বাবা নূর হোসেন দেওয়ান দেওয়ান ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে নড়িয়াসহ আশেপাশের এলাকা থেকে রোগীরা আসতেন। যেখানে কারও কাছ থেকে চেয়ে কোনো ফি নেওয়া হতো না, দরিদ্র রোগীরা যে যা পারতেন তাই দিতেন এই ক্লিনিকের চিকিৎসকদের।
স্থানীয়দের কাছে জানা গেল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাউন্ডারির ঘেঁষে ছিল ২০ ফুট প্রস্থের সরকারি রাস্তা, সেটার উল্টোদিকেই ছিল দেওয়ান ক্লিনিক, সেই সাড়িতেই ছিল দেওয়ান রওশন আর প্লাজা ছিল তিনতলার একটি শপিং মল, তার পাশেই ছিল দেওয়ান বাড়ি।
সেদিনের ঘটনা সর্ম্পকে জানতে চাইলে সোহেল বলেন, সেদিন দুপুর দুইটা থেকে আড়াইটার দিকে একেবারে চোখের নিমীষে ধীরে ধীরে ক্লিনিকটা পদ্মায় চলে গেল, কলিজা ফাটার মতো অবস্থা ছিল সেটা, বলেন সোহেল। তিনি আরও বলেন, এতোদিনের গড়ে তোলা নিজেদের ক্লিনিক চলে গেল, চেয়ে চেয়ে দেখলাম, কিচ্ছু করার নেই। দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
বাড়ি যখন নদীতে চলে যাবে তখন অনেকেই বাড়ি ঘর ভেঙে ইট বিক্রি করে দেন, ঘরের রড বিক্রি করে দেন কিন্তু আমার বাবা একটা নির্দেশ দিয়েছিলেন-ওখান থেকে একটা ইট-ও সরানো যাবে না, ক্লিনিকের একটা যন্ত্রও আমরা সরিয়ে আনিনি-সবসহ একেবারে নদীগর্ভে চলে গেল। ক্লিনিকের পেছন দিকে নিজেদের বাড়িও গিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নড়িয়া থানাতে আমাদের একটি কাঠের বাড়ি ছিল যা কি না নড়িয়ার ঐহিত্য ছিল, সেই কাঠের বাড়িসহ নিজেদের থাকার বাড়িটাও চলে গিয়েছে মাস দেড়েক আগে।
গত ২৬ বছর ধরে পদ্মার এই ভয়াবহ রুপ চলছে, পদ্মার ভাঙন চলছে মন্তব্য করে সোহেল দেওয়ান বলেন, চলতি বছরে বর্ষা মৌসুম শুরু হবার দুই মাস আগে অর্থ্যাৎ জুলাই মাসের শুরুতেই এই ভাঙ্গন শুরু হয়।
নিজেদের বাড়ি চলে যাবার পর তার আরেক ভাইয়ের শ্বশুড় বাড়িতে থাকছেন, আরও দুই ভাইয়ের স্ত্রীরা থাকছেন নিজেদের বাবা বাড়িতে। পরিবারের অন্যরাও আছেন হাসপাতালের পরিত্যক্ত কক্ষগুলোতে।
মাত্র দুই মাসে আমাদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ গিয়েছে আর যাদের একটি ঘর ছিল সেই ঘরটাও হারিয়েছে তারা। কিন্তু এই নদী ভাঙ্গন নিয়ে জনপ্রতিনিধিরা কোনো কথা বলেননি, কোনো কাজ করেননি। তারা যদি বিষয়টি নিয়ে কাজ করতেন তাহলে নড়িয়াবাসী এতবড় সমস্যার সম্মুক্ষিণ হতেন না।
দেওয়ান ক্লিনিকে ২০০৫ সাল থেকে রোগী দেখতেন ডা. গোলাম ফারুক বাবুল। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, নড়িয়ার দুই ইউনিয়ন চরআত্রা আও নওয়াপাড়া দুটিই পদ্মার ভেতরে। আর জলবায়ু এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, পদ্মা শাখা-উপশাখা নদীগুলো মরে যাওয়াই পদ্মার এই ভয়ংকর রুপের কারণ।
একইসঙ্গে পদ্মার স্রোত এখন পাড়ঘেষা মন্তব্য করে ডা. গোলাম ফারুক বাবুল বলেন, পদ্মার ভেতরে আগে স্রোত থাকলেও এখন সেটা চলে এসছে ৫০০ গজের ভেতরে। নদীর ভেতরে গভীরতা নেই, নাব্যতা নেই, যদি নদীর ধারণকক্ষতা থাকতো তাহলে পাড়ে স্রোতের এই চাপটা থাকতো না। অথচ পানি কিন্তু কমছে, বর্ষাকালে আগে পানি থাকতো পদ্মায় এখন তার তিনভাগেরর একভাগ পানি রয়েছে। কিন্তু যেটুকু পানিও রয়েছে তার সরার জায়গা নেই, যার কারণে পদ্মার স্রোত পাড়ঘেষা এবং সেটুকুই অত্যন্ত ভয়ংকর-বলেন তিনি।
সারাবাংলা/জেএ/এমআই