ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১৪ জনের, প্রকোপ বাড়ার শঙ্কা
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৩১
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: চলতি বছর বর্ষা মৌসুমের চাল-চরিত্র সেভাবে টের না পেলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ ঠিকই টের পাচ্ছেন নগরবাসী। ভয়াবহ এ রোগে এখন পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে। যার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুইজন, মিটফোর্ড হাসপাতালে একজন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে দুইজন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একজন এবং বারডেম হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সামনের দিনগুলোয় বৃষ্টি হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
এছাড়া বেসরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, স্কয়ার হাসপাতালে একজন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে দুইজন, ইউনাইটেড হাসপাতালে দুইজন এবং পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন করে রোগী মারা যান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরে ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। সে কারনে আক্রান্ত হওয়ার শুরুর দিকে সেভাবে বোঝা যায় না। এতে করে চিকিৎসায় গুরুত্ব না দেওয়ায় পরবর্তীতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়। চিকিৎসকরাও শেষমেষ তেমন কিছু করতে পারছেন না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১৩০ কোটি মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছেন। এছাড়া বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর ৫৮ শতাংশ মানুষ এই অঞ্চলে বাস করেন যাদের ৫৮ ভাগ মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়, সে বছরে রেকর্ড সংখ্যক ৯৩ জন রোগী মারা যান, রোগী ছিলেন ৫ হাজার ৫৫১ জন, ২০০১ সালে মারা যান ৪৪ জন, রোগী ছিলেন দুই হাজার ৪৩০ জন, ২০০২ সালে মারা যান ৫৮ জন, রোগী ছিলেন ৬ হাজার ২৩২ জন, ২০০৩ সালে মারা যান ১০ জন, রোগী ছিলেন ৪৮৬ জন, ২০০৪ সালে মারা যান ১৩ জন, রোগী ছিলেন ৩ হাজার ৪৩৪ জন, ২০০৫ সালে মারা যান ৪ জন, রোগী ছিলেন ১ হাজার ৪৮ জন, ২০০৬ সালে মারা যান ১১ জন, রোগী ছিলেন দুই হাজার ২শ জন, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কেউ মারা না গেলেও রোগী সংখ্যা ছিলেন যথাক্রমে ৪৬৬ জন, এক হাজার ১৫৩ জন, ৪৭৪ জন এবং ৪০৯ জন। তবে তার পরের বছর থেকেই আবার রোগী মৃত্যু শুরু হয়।
২০১১ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৩৫৯ জন, ২০১২ সালে মারা যান একজন, রোগী ছিলেন ৬৭১ জন, ২০১৩ সালে মারা যান ২ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৭৪৯ জন, আবার ২০১৪ সালে কেউ মারা না গেলেও রোগী ছিলেন ৩৭৫ জন। ২০১৫ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন ৩ হাজার ১৬২ জন, ২০১৬ সালে মারা যান ১৪ জন, রোগী ছিলেন ছয় হাজার ৬০ জন এবং গত বছরে মারা যান ৮ জন এবং রোগী সংখ্যা ছিলেন দুই হাজার ৭৬৯ জন। চলতি বছরের জুন মাসে তিন জন, জুলাই মাসে চার জন, আগস্ট মাসে ছয় জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে এক জন মারা যান।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪১৮ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৯৪ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১০ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০৭ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬৫ জন, বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০৭ জন। অপর দিকে, এসব হাসপাতালে বর্তমানে রোগী ভর্তি আছেন যথাক্রমে ৫৫, ৬৬, ২৩, ১৭ এবং ১৩ জন রোগী। অপরদিকে ঢাকায় অবস্থিত বেসরকারি হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২৫ জন এবং হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছেন ৯৪ জন রোগী। ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন চার হাজার ৪২৬ জন রোগী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যাণ্ড, পূর্ব তিমুর ও উত্তর কোরিয়া রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মানুষ এই অঞ্চলে বসবাস করে। দ্রুত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলে এই দু’টি রোগ ছাড়াও কীটবাহিত অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।
কেবল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানেই নয়, চলতি বছর বাংলাদেশেও বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। গত ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গু জ্বর, ডেঙ্গু হেমরেজিক ফিভার এবং ডেঙ্গু শক্ সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৪৮ জন।
এদিকে, চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুর ধরন বদলানোয় কেবল মশক নিধন চেষ্টায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যাবে না বলে সারাবাংলাকে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘নিজের বাড়ি-ঘর পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। ঘরের ভেতরে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তার ধারের ড্রেনগুলোতে পানি জমে যাচ্ছে, পরিষ্কার পানি পেয়ে সেখানে মশা ডিম পাড়ার সুযোগ পাচ্ছে। ড্রেনেজ সিস্টেমগুলো সিটি করপোরেশনকে ঠিক করতে হবে, কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সে ব্যবস্থা নিশ্চিতকরতে হবে। নয়ত এবার ডেঙ্গু অনেক ভোগাবে।’
অপরদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে জনসাধারণকে সচেতন থাকার কথা বলছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ‘এবারের মৌসুমে ভারি বর্ষণে এডিস মশাবাহিত রোগ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ডেঙ্গুর মৌসুম হচ্ছে জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। আশা করতে পারি যদি বৃষ্টিপাত আর না হয় তাহলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বৃষ্টি হলে সেটা বাড়তে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডেঙ্গুর ঝুঁকি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ঝুঁকি বেড়েছে, এর প্রমাণ চলতি বছরগুলোতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তনএবং বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এ প্রকোপ বেড়ে গিয়েছে।’
‘তবে এর প্রতিকারের জন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে, সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ সর্ম্পকে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা এবং জনসচেতনামূলক কাজে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবী,সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাদেরও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করতে হবে’, বলেন ডা. এ এস এম আলমগীর।
সারাবাংলা/জেএ/এমএস/একে