Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্কুলের ঘাটতি পূরণে কোচিংয়ে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা


২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৮

।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা। অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি এ এলাকার পরিচিতি কোচিং পাড়া হিসেবে। বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা, প্রফেশনাল কোর্স কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এ এলাকার। সেখানে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে একাডেমিক কোচিং। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাকে ঘিরে এ এলাকার কোচিং বাণিজ্য এখন রমরমা।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের কোচিংমুখী প্রবণতা বাড়ছে। আর অভিভাবকরা বলছেন, স্কুলে পড়ালেখায় ঘাটতি থাকায় চাপ হলেও সন্তানদের কোচিংয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

সরেজমিনে রাজধানীর পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকার বিসিএ কোচিং সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, তিন তলা ভবনের প্রায় প্রতিটি কক্ষেই কোচিং ক্লাস চলছে। ভর দুপুরে এ কোচিংয়ে একইসঙ্গে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির দুইটি করে ব্যাচ পড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য ক্লাসেরও ব্যাচ পড়ছে। কোচিংয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আল আমিন সারাবাংলাকে জানান, তাদের কোচিংয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের প্রায় সবাই ফার্মগেট এলাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ (স্কুল শাখা) ও হলিক্রসের মতো স্কুলের শিক্ষার্থীরাও আছে। মূলত স্কুলে পড়ালেখার যে ঘাটতি, সেটুকু পূরণের জন্যই শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে থাকে— বলেন তিনি।

বিসিএ কোচিংয়ের পাশের গলির মেধানীড় কোচিংয়ের পড়ছে সরকারি বিজ্ঞান স্কুলের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান। কোচিংয়ের সামনেই কথা হয় তার সঙ্গে। তার মতে, বছরের একটা বড় সময় স্কুল বন্ধ থাকে। আবার যখন ক্লাস হয়, তখন সব বিষয় ভালো করে পড়ান না শিক্ষকরা। বিষয়টি বুঝতে পেরে তারা বাবা আজিজুর রহমান কোচিংয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

মেধানীড় কোচিংয়ের পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, কয়েক বন্ধু মিলে বছর দেড়েক আগে ফার্মগেট এলাকায় এ কোচিং সেন্টারটি শুরু করেন তারা। প্রথম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়াদের কোচিং করান তারা। মাসে ১৫শ টাকা টিউশন ফি দিতে হলেও বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের যা দিচ্ছেন, তা অনেক বেশি বলে দাবি করেন তিনি।

জসিম উদ্দিন বলেন, ‘স্কুলে কোনো পড়ালেখাই হয় না। বিশেষ করে সৃজনশীল বিষয়গুলো শিক্ষকরা যেমন বোঝেন না, তেমনি পাঠ্য বইয়েও বিস্তারিত কিছু নেই। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে বই পড়ে বুঝবেন, তা হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদের কোচিংমুখী হতে হচ্ছে।’ এক্ষেত্রে কোচিং আছে বলেই অভিভাবকরা কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন বলে মনে করেন তিনি।

এই কোচিংয়ের সামনেই কথা হয় আকলিমা আক্তার নামের এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি জানান, তার মেয়ের স্কুলে শিক্ষকরা ক্লাসে ভালো করে পড়ান না। ‘ভালো করে পড়ালে কে টাকা-সময় নষ্ট করে সন্তানকে কোচিংয়ে ভর্তি করায়?’— উল্টো প্রশ্ন করেন তিনি।

কেবল ফার্মগেট এলাকা নয়, অলিগলিতে কোচিং সেন্টার গজিয়ে ওঠার এই চিত্র ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই। বিশেষ করে যেসব এলাকায় ভালো হিসেবে পরিচিত স্কুল-কলেজ রয়েছে, সেসব স্কুল-কলেজকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে প্রচুর কোচিং সেন্টার। এর কোনোটিতে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি, কোনোটিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, আবার কোনোটিতে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্তও পড়ানো হয় শিক্ষার্থীদের। কিছু কিছু কোচিং আবার মূলত পাবলিক পরীক্ষাকেন্দ্রিক ও মডেল টেস্ট নির্ভর। আর স্কুলে ভর্তির জন্য কোচিং তো রয়েছেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রায় সাড়ে ছয় বছর ধরে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গত বছর কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধ করে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই খসড়ায় সহায়ক বা অনুশীলন বই প্রকাশের সুযোগ রাখা হয়নি । এসব অপরাধে কেউ জড়িত হলে জেল-জরিমানা বা চাকরিচ্যুত (শিক্ষক হলে) করা হবে এমন বিধান রাখা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের মতামত পাওয়ার পর খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন আনুষঙ্গিক কিছু কাজ করে শিগগিরই খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে মন্ত্রিসভা থেকে।’ মন্ত্রিসভাও কোচিং, প্রাইভেট টিউশন ও নোট-গাইড বা অনুশীলন বই নিষিদ্ধ করার পক্ষে বলে জানান তিনি।

তবে ওই খসড়া প্রণয়নের পর একবছর পেরিয়ে গেলেও আইন হিসেবে পাস হওয়ার প্রক্রিয়া আর এগোয়নি।

ফার্মগেটের কোচিং পাড়া সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যে আইনের উদ্যোগ নিয়েছে তাতে শিক্ষকদের সরসরি জড়িত থাকার একটি বিষয় রয়েছে। তবে কোচিংগুলোতে যারা পাঠদান করছেন, তাদের অধিকাংশই বেকার, শিক্ষার্থী কিংবা পার্টটাইম শিক্ষক। তারা মূলত স্কুলের ঘাটতি পূরণেই শিক্ষার্থীদের সাহায্য করছেন।

ওই এলাকার বৃত্ত কোচিং সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট বেশ কয়েকটি কক্ষে বিভিন্ন ক্লাসের কোচিং চলছে। সামনে প্রবেশ পথের পাশে বেশ কয়েকজন অভিভাবক বসে আছেন। তাদের মধ্যে কাওসার হোসেন নামের একজন অভিভাবক বলেন, স্কুলে যা পড়ায় তাতে ভালো ফল সম্ভব নয়। তাই মেয়েকে এ কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছেন গত মার্চ মাসে। মাসে অতিরিক্ত টাকা খরচ হলেও কিছু করার নেই। তার মতে, কোচিংয়ের শিক্ষকরা খুব যত্ন নিয়ে পড়ান।

বৃত্ত কোচিংয়ের অফিস কক্ষে কথা হয় আফরিন জাহান নামের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, পিইসি পরীক্ষার খুব বেশি বাকি নাই। এখন শিক্ষার্থীদের মডেল টেস্ট চলছে। শেষ সময় হলেও এখনও শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাচ্ছে তাদের কোচিংয়ে। সেক্ষেত্রে সাড়ে চার হাজার টাকা দিলে সমাপনী পরীক্ষা পর্যন্ত তাদের কোচিংয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।

কোচিং ও গাইড বই নিষিদ্ধ করে ক্লাসেই মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের দাবি দীর্ঘদিনের। শিক্ষা গবেষকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও এ নিয়ে নানামুখী তৎপরতা চলেছে বিভিন্ন সময়। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ক্লাসে যেমন শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি, তেমনি কোচিং কিংবা গাইড বইও বিলুপ্ত করা যায়নি। এতে করে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, পাঠ্যপুস্তককে পাশ কাটিয়ে গাইড বই ও স্কুলের বদলে কোচিং সেন্টার শিক্ষার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। এতে একশ্রেণির লোক উৎরে গেলেও দেশের একটি বিশাল অংশ তাল মেলাতে পারছে না। সন্তানদের পড়ালেখা শেখাতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ বিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে এমন অতিরিক্ত চাপে পড়তে হতো না।

সারাবাংলা/এমএস/টিআর

কোচিং বাণিজ্য কোচিং সেন্টার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর