শ্রমিক স্বার্থের পরিবহন ধর্মঘটে অর্থনীতিতে ক্ষত
৩০ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:২৫
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।
ঢাকা: পরিবহন শ্রমিক নেতাদের ডাকে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট শেষ হয়েছে মঙ্গলবার (৩০ অক্টোবর) ভোর ৬টায়। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার এই ধর্মঘটের ভুক্তভোগী দেশের জনগণ, পণ্য ও সেবা ব্যাবস্থা, সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ধর্মঘটকে জনজীবনের জন্য সাময়িক ভোগান্তির কারণ হিসেবে বলা হলেও তা মূলত দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে তৈরি করে ক্ষত।
আবদুল হালিম একজন সবজি ফেরিওয়ালা। ভোরে নগরীর কারওয়ান বাজার থেকে সবজি এনে সারাদিন ঠেলাগাড়িতে করে বিক্রি করেন শহরের বিভিন্ন স্থানে। দু’দিনের পরিবহন ধর্মঘট কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাকে? জিজ্ঞাসা করতেই জানান, গতকাল (রোববার) থেকেই বাজারে পণ্যের আকাল। সকালে কাড়াকাড়ি করে যেটুকু পেয়েছি, তা অন্যান্য দিনের অর্ধেকেরও কম। ওদিকে দামও প্রায় দেড়গুণ। এসব সবজি বেশি দামে বিক্রি করতে হয়েছে। তারপরও এই দুই দিনে বেচাবিক্রি থেকে যা আয় করেছি, তা স্বাভাবিক আয়ের প্রায় অর্ধেক।
আবদুল হালিমেরই একজন ক্রেতা মেহজাবীন রহমান। তিনি একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। স্বাভাবিক নিয়মে তিনি বাসে বা রিকশায় করে চলাচল করলেও পরিবহন ধর্মঘটে তাকে চড়তে হয় সিএনজি বা অ্যাপভিত্তিক কোনো রাইডে। মেহজাবীন বলেন, দিনে আমার চলাচলের খরচ এমনিতে একশ টাকা। ধর্মঘটের দুই দিনে প্রতিদিন খরচ হয়েছে প্রায় পাঁচশ টাকা। এ ছাড়াও দুই দিনই আমার অফিস পৌঁছতে দেরি হয়েছে। এরকম দেরি এই মাসে আর একটা দিন হলেও আমার এক দিনের বেতন কাটা পড়বে।
আবদুল হালিম বা মেহজাবীনের আর্থিক ক্ষতি এককভাবে খুব বড় করে না দেখা গেলেও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এই ক্ষতির প্রভাব অনেক বড় বলে মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের। তবে এই ক্ষতিও সব নয়। পরিবহন ব্যবস্থা অচল হওয়ার ফলে ভেঙে পড়েছে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষক, পণ্য সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং ক্রেতা।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক গাজী এম এ জলিল সারাবাংলাকে বলেন, যখন পরিবহন ব্যবস্থা স্থবির হয়ে যায়, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই কৃষি পণ্যের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কেননা কৃষি পণ্যের একটি বড় অংশ পচনশীল। কিন্তু কৃষি পণ্যের চাহিদা নির্দিষ্ট। ফলে একদিকে যেমন চাহিদার তুলনায় কম জোগান হওয়ার পণ্যের দাম বেড়ে যায়, অন্যদিকে একটি বিরাট অর্থের সমপরিমাণ পণ্যের ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি হওয়া পণ্যের ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। এমনকি অল্প কিছু পণ্যের দাম যদি বেশি নেওয়াও হয়, তার সুফল পণ্য বিক্রেতা, পণ্য সরবরাহকারী বা কৃষক পর্যন্ত পৌঁছায় না। অর্থনীতিতে এই ক্ষতির দায় তখন সবাইকেই কম-বেশি নিতে হয়।
গত ৬ অগাস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক পরিবহন আইন উত্থাপিত হলে তা সর্বসম্মিতক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এই আইন। এর মধ্যে গত ২২ অক্টোবর পোস্তগোলা ব্রিজের টোলের হার ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৪০ টাকা করা হয়। শুক্রবার (২৬ অক্টোবর) ট্রাক শ্রমিকরা এর প্রতিবাদ করায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে একজন শ্রমিক নিহত হন। এরপর গত ২৭ অক্টোবর পরিবহন শ্রমিকরা আইনের বিষয়ে আবার নড়েচড়ে বসেন। শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সাদিকুর রহমান ২৮ ও ২৯ অক্টোবর পরিবহন ধর্মঘট ডাকেন। এই ধর্মঘটের সঙ্গে তারা আট দফা দাবিও জুড়ে দেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারবে না। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা আইনে কোথাও বলা নেই, সড়ক দুর্ঘটনার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনার ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
২৭ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডাকা শ্রমিক ফেডারেশোনের সমাবেশে সভাপতি সাদিকুর রহমান আরও বলেন, ফাঁসির আইন মাথায় নিয়ে শ্রমিকরা পথে গাড়ি চালাবে না। রাস্তায় গর্ত থাকে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই দায় একা শ্রমিকের হতে পারে না।
ফাঁসির দায় মাথায় নিয়ে কাজ করতে না চাওয়ার দাবি শ্রমিকদের এই প্রথম নয়। ২০১১ সালের ১৩ অগাস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের জোকা এলাকায় বিপরীতগামী যাত্রীবাহী একটি বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসে থাকা চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচ জন নিহত হন। ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায়ে ঘাতক বাসচালককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকেন, তাতে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সারাদেশ থেকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান সেসময় সরকারের মন্ত্রীর চেয়ে বেশি ফেডারেশনের নেতার ভূমিকা পালন করেন এবং রায় মেনে না নিয়ে শ্রমিকদের পক্ষে বক্তব্য দেন।
অভিযোগ আছে, মন্ত্রীর বাসভবন থেকে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ধর্মঘটের ফলে সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে। সে সময় মন্ত্রীর শ্রমিকদের পক্ষে দেওয়া, ‘চালকরা মনে করছেন মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের মতো রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবেন না’ বক্তব্যটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।
এবারের ধর্মঘটেও জনজীবন যথেষ্ট বিপর্যস্ত। ধর্মঘটের কারণে প্রাণ গেছে সিলেটের বড়লেখা উপজেলার সদর ইউনিয়নের একটি শিশুর। অসুস্থ শিশুটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে আনার পথে ধর্মঘট পালনকারী শ্রমিকরা শিশুটিকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্সকে বাধা দেয়। দেড় ঘণ্টা পরে যখন অ্যাম্বুলেন্সটিকে ছাড়া হয়, ততক্ষণে প্রাণ হারায় শিশুটি।
শ্রমিকদের এই ধর্মঘট বিষয়ে কথা হয় সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, পরিবহন খাতের ধর্মঘটের আইনি পর্যায় যদি কথা বলতে হয়, আমরা জানি আইনটি অনেক বিবেচনা করে সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে। আইনি কাঠামোটি যদি অন্যান্য দেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তবে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি সবাই এটা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। এখন শ্রমিকদের যদি এই আইনে কোনো সমস্যা থাকে, যেমন— যদি এই আইন বাস্তবায়নে সময় প্রয়োজন হয় কিংবা আর্থিক বা কারিগরি সহযোগিতা প্রয়োজন হয়, তারা সেগুলো নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা করতে পারেন।
এছাড়াও আইন যদি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদে অন্তরায়ের কারণ হতে পারে। ফলে এই বিষয়টিতেও নজর দেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন এ গবেষক।
ধর্মঘট কীভাবে দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে, সে প্রসঙ্গে ড. মোয়াজ্জেম বলেন, এ ধরনের ধর্মঘটের প্রভাব অর্থনীতিতে দিন দিন বাড়ছে। এর ফলে যেমন একদিকে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে যাত্রী, পণ্য বা সেবা পরিবহন ব্যহত হচ্ছে; আবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবহনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোও ব্যহত হচ্ছে। যেহেতু আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও নিবিড় হচ্ছে, ফলে এখানে পরিবহনের ভূমিকা বেড়েছে। ফলে পরিবহনের অভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতিও বেড়েছে বলে আমি মনে করি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ খাতে একদিকে যেমন পণ্য উৎপাদক বা বিক্রেতারা পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে কম মূল্য পাওয়া বা মূল্য না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন, অন্যদিকে ভোক্তাও বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পাশাপাশি সরবরাহকারীরাও আয় হারাচ্ছে। তাছাড়াও জরুরি সেবা, যেমন— ওষুধ, চিকিৎসা সেবা বা জরুরি পণ্যের চালানও ব্যহত হচ্ছে। এ কারণে শুধু আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে না, বিক্রেতা তার সুনামও হারাচ্ছেন।
এদিকে, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পরিবহন না থাকার কারণে বন্দরগুলোতে পণ্য বেশি দিন রাখতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করা যাচ্ছে না, ফলে জাহাজটিও সময়ের চেয়ে বেশিদিন বন্দরে আটকে আছে। এতে পণ্য সরবরাহে ঝুঁকি নিতে হচ্ছে বা বিমানযোগে পাঠানোর মতো ব্যয়বহুল ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। ফলে খরচ বাড়ছে। ড. গোলাম মোয়াজ্জেম আশঙ্কা করছেন, এমন ধর্মঘট যদি চলতে থাকে তাহলে অর্থনীতিতে এর চাপ ক্রমেই বাড়বে।
এ পরিস্থিতিতে সোমবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী আট দফা দাবি মেনে নিতে ২১ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন। এর মধ্যে দাবি মেনে নেওয়া না হলে ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দিয়ে রেখেছেন তারা। এ ধর্মঘট জনজীবনে আরও কত দুর্গতি ডেকে আনে, সে আশঙ্কায় এখন সাধারণ মানুষ।
আরও পড়ুন-
২৮-২৯ অক্টোবর সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক
সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘট, ছাড়ছে না দূরপাল্লার বাস
ঢাকা থেকে ছাড়ছে না দূরপাল্লার বাস, বিপাকে যাত্রীরা
৯৬ ঘণ্টার অবরোধের হুমকি, ৩ সপ্তাহের আল্টিমেটাম
সারবাংলা/এমএ/এমএস/টিআর