‘ওরা গাড়ি পোড়ায়নি, আমাকে পুড়িয়ে দিয়েছে’
১৮ নভেম্বর ২০১৮ ২২:৫১
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘দৌড়ে এসে এপিসিতে না উঠতে পারলে ওরা হয়তো আমাকে মেরেই ফেলত। পরিস্থিতি দেখে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল, তাদের টার্গেট ছিল পুলিশ। কারণ সুনির্দিষ্ট কাউকে তারা আঘাত করেনি, যেখানে যে পুলিশকে পেয়েছে সেখানেই সে পুলিশকে আঘাত করেছে। তাই লাঠি ও ইটপাটকেলের আঘাত সহ্য করে এপিসিতে উঠে নাইটিঙ্গেল মোড়ের দিকে দ্রুত চলে আসি। এসময় দেখলাম, তারা আমার ডাবল কেবিনের ডিউটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। নিজের ব্যবহৃত গাড়িটি চোখের সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। মনে হলো— ওরা গাড়ি পোড়ায়নি, আমাকে পুড়িয়ে দিয়েছে।’
গত ১৪ নভেম্বর দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালের দশম তলায় চিকিৎসাধীন মতিঝিল জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মিশু বিশ্বাস।
আরও পড়ুন- নয়াপল্টনে যে কারণে পিছু হটেছিল পুলিশ
সারাবাংলাকে তিনি বলছিলেন, ওইদিনের দুঃসহ মুহূর্তগুলো এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। একই অবস্থা হাসপাতালের ওই ফ্লোরে চিকিৎসাধীন আরও চার পুলিশ কর্মকতার। এর মধ্যে মতিঝিল জোনের সহকারী কমিশনার (এসি, প্যাট্রল) মো. ইলিয়াস হোসেন ও মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) এস এম শিবলী নোমানের সঙ্গেও কথা হয়। তারা সবাই বলছেন, শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠছেন তারা। তবে ওই ঘটনার মানসিক আঘাত এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
এসি মিশু বিশ্বাস বলেন, ‘আমি তখন মসজিদ গলির মুখে। দুপুর ১টা ৫ বা ১টা ১০ মিনিটের দিকে দেখতে পেলাম, বিএনপি পার্টি অফিসের সামনে হৈ হুল্লোড় হচ্ছে। পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছে, তা বুঝতে পারিনি। দেখতে দেখতে সংঘর্ষে রূপ নেয় পরিস্থিতি।
মিশু বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন নেতাকর্মী হঠাৎ আমার দিকে তেড়ে এসে প্রথমে আমাকে লাঠি দিয়ে পিঠে ও পরে পায়ে আঘাত করে। এরপর আমি ও আমার বডিগার্ড আত্মরক্ষায় দৌড় দেই। এসময় চারদিক থেকে ইটপাটকেল গায়ে এসে পড়ছিল। প্রথমে চিন্তা করলাম, থানার দিকে যাব। পরে আবার ভেবে দেখলাম, থানায় যেতে চাইলে কাভার করতে পারব না। এসময় দেখলাম আমাদের এপিসিটা (সাঁজোয়া যান) ঘেরাও করে ফেলেছে। এপিসিটা তারা কন্ট্রোলে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল।
‘তাই লক্ষ্য ছিল এপিসিটাকে রক্ষা করা। কারণ এপিসিতে আমাদের অস্ত্রসহ সব সরঞ্জাম রয়েছে। তাই জীবন বাঁচাতে থানায় না গিয়ে দৌড়ে গিয়ে এপিসিতে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। ওই সময়ও কেউ লাঠি দিয়ে, কেউ ইটপাটকেল ছুঁড়ে আঘাত করছিল। এর মধ্যেই এপিসিতে উঠলাম, কিন্তু দরজা লাগাতে পারছিলাম না। কারণ তারা দরজা বন্ধ করতে দিচ্ছিল না। তারাও এপিসিতে ওঠার চেষ্টা করছিল। দুই-তিন সেকেন্ডের মধ্যে এপিসির প্রিপারেশন নিয়ে আমি কয়েক রাউন্ড ফায়ার করি। এতে তারা দলছুট হয়ে গেলে আমি এপিসি নিয়ে মসজিদ গলি থেকে নাইটিঙ্গেল মোড়ের দিকে চলে যাই,’— বলছিলেন এসি মিশু বিশ্বাস।
তিনি আরও বলেন, ‘তখন অনেক চেষ্টা করেও বিএনপি নেতাকর্মীদের তোপের মুখে গাড়ির কাছে যেতে পারিনি। যেতে পারলে গাড়ি রক্ষা করতে না পারলেও গাড়িতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলো ও আমার মোবাইল ফোনটি বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু গাড়ির কাছে গেলে হয়ত ওরা এপিসিটাই দখলে নিত। এপিসিতে থাকা অস্ত্রও হয়তো লুট করত। তাই নিজের গাড়িটা পুড়ে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি।’
আহত আরেক কর্মকর্তা মতিঝিল জোনের এসি (প্যাট্রল) মো. ইলিয়াস হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ইট-পাটকেলের আঘাতে হেলমেট ভেঙে মাথা জখম হয়েছে। পায়েও আঘাত পেয়েছি। তবে হেলমেট পরা না থাকলে হয়তো ইটপাটকেলের আঘাতে মারাই যেতাম।
ইলিয়াস জানান, তার গাড়িও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাত্র মাস দুয়েক আগে কেনা গাড়িতে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল ফোনও ছিল।
ওই দিনের ঘটনা বলতে গিয়ে এসি ইলিয়াস বলেন, আমরা ছিলাম হোটেল ভিক্টোরির সামনে। এসময় একজন কনস্টেবল এসে বলল, পুলিশের ওপর হামলা করছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। এ কথা শুনে আমি আর নোমান স্যার (এডিসি) পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখি, একের পর ইট মারছে আমাদের দিকেও। আমরা দ্রুত পিছিয়ে ভাসানী গলির দিকে চলে যাই। আমরা হয়তো পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। সেক্ষেত্রে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারত। সে কারণে আমরা পিছু হটে যাই।
ওই দিনের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হন মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) এস এম শিবলী নোমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, সকাল থেকে তাদের মনোয়ন ফরম বিক্রির কারণে পার্টি অফিসের সামনের সড়কটিতে যানচলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা সড়কে যানচলাচলে অন্তত একটা লেন চালু রাখতে সেখানে কাজ করছিলাম। কিন্তু দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিট বা তার কিছু আগে মির্জা আব্বাসের একটা বড় মিছিল পার্টির অফিসের সামনে আসে। এতে সড়কে সকাল থেকে যে এক লেন ছিল, সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমাদের পুলিশ সদস্যরা সেসময় নেতাকর্মীদের সড়ক ছেড়ে রাস্তার পাশে অবস্থান নেওয়ার অনুরোধ করে। এতেই নেতাকর্মীরা আমাদের রেজাউল নামের একজন এসআইকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে রাস্তায় ফেলে দেয়। এসময় অন্য একজন এসআইকে গলা চেপে ধরে তারা। এতে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে খানিকটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, নেতাকর্মীদের মারমুখী ভঙ্গি দেখে আমি পুলিশ সদস্যদেরকে ব্যাক করে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। তখনই তারা আমাদের ওপর আক্রমণ করে। মুহূর্তেই দেখলাম শতশত ইটপাটকেল আর লাঠি নিয়ে নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গাড়িতে আগুন দিয়েছে। এটা যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল, সেটি স্পষ্ট বোঝা গেছে। কারণ এত ইটপাথর আর লাঠিসোটা রাস্তায় ছিল না। এগুলো আনা হয়েছে।
এডিসি শিবলী নোমান বলেন, আমরা চাইলেই তাদেরকে প্রতিহত করতে পারতাম। আমাদের প্রস্ততিও ছিল। কিন্তু সংঘাত এড়ানোয় ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। তাই যারা এসব কাজ করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে চেষ্টা করেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ১৪ নভেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সড়কে যানচলাচলকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর নয়াপল্টনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এতে পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তা ও তিন আনসার সদস্যসহ মোট ২৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে তাদেরকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ওইদিন সন্ধ্যায় আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাবেদ পাটোয়ারী ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। ওই রাতেই এ ঘটনায় পল্টন মডেল থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত বিএনপির ৬৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের পর বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে মামলা তদন্ত কার্যক্রম গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-
নয়াপল্টনের ঘটনায় ইসিকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি আ’লীগের
নয়াপল্টনের ঘটনা তদন্তে চারদিনেও পুলিশকে চিঠি পাঠায়নি ইসি
নয়াপল্টনে শো ডাউন আচরণবিধি লঙ্ঘন না, সহিংসতার ব্যাখ্যা চাইবে ইসি
সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর