পান-জর্দা-গুল-তামাকে বাড়ছে মুখের ক্যান্সার
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৮:৩৮
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ব্লকের তিনতলায় ওরাল অ্যান্ড মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগ। চিকিৎসকদের কক্ষের বাইরে বারান্দায় বেঞ্চের ওপর মাথায় কাপড় টেনে ডান পাশের পুরো গাল ঢেকে বসে রয়েছেন বয়স্ক এক নারী। পরনের লাল-কালো সুতি শাড়ি দেখেই বোঝা যায় দিন এনে, দিন খান।
একটু ‘কেমন যেন চাহনি’ তার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। পাশে গিয়ে বেঞ্চে বসতেই একটু দূরে যান তিনি, আরও টেনে নেন গালের কাপড়। কি হয়েছে জানতে চাইতেই থেমে থেমে বলেন, ‘কি যে হইছে মা বুঝিতো না, কিন্তু জানডাটাতো আর ঠাণ্ডা হয় না’।
গালে কি হয়েছে প্রশ্ন করলে এবার তিনি কাপড় সরিয়ে নেন। সে এক বীভৎস দৃশ্য! ডান পাশের গালে বেশ বড় ঘা, গর্তের মতো হয়ে ফাঁকা গিয়ে গিয়েছে। কিছুটা অতিরিক্ত মাংসপিণ্ড জমা হয়েছে ঠোঁটের পাশেও। জানালেন চাঁদপুর থেকে এসেছেন, নাম রাজিয়া বেগম। তবে নিজের ঠিক বয়সটা জানাতে পারলেন না। বললেন, ‘হইবো ৬০ থেইকা ৬৫।’
এক বছর আগে থেকে রাজিয়া বেগমের মুখে ক্যান্সার ধরা পরে। প্রথমে চাঁদপুরে চিকিৎসা হয়, সেখান থেকে ছেলেরা গত একমাস আগে নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেবারে ছুড়ি-কাঁচির ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে ছিলেন রাজিয়া। তবে তাকে আবার আসতে হয়েছে। ছেলের বউ সালমা বলেন, ‘ব্যথায় চিৎকার করে, রোগটা অনেক বেশি গাড়াইয়া গেছে, ঘুমাইলে রক্তে সব ভাইস্যা যায়।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে ৩১.৭ শতাংশ মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করলেও ধোঁয়াবিহীন তামাকের ভয়াবহতা সর্ম্পকে মানুষ সচেতন নয়। মানব উন্নয়ন সূচকের তথ্য থেকে জানা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য ব্যববহার করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুখের ক্যান্সার নিয়ে যতো রোগী আসে তার মধ্যে শতকরা ৯৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যে আসক্ত থাকার কারণে। যারা পান-জর্দা-গুল খাচ্ছে তাদের সবারই ক্যান্সার হচ্ছে না কিন্তু যাদের ক্যান্সার হচ্ছে তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি এই ধোঁয়াবিহীন (পান-জর্দা-গুল-সাদাপাতা) তামাকে আসক্তির কারণে। মুখ, গলা এবং জিহ্বার ক্যান্সারের প্রধান কারণ এই ধোঁয়াবিহীন তামাক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরাল অ্যান্ড মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ওরাল ক্যান্সার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহমুদা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহারের কারণে ক্যাান্সারাক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আউটডোরে এসছে ১০৩ জন- শুধু ওরাল ক্যান্সার-ডায়াগনোসড কেস।’
বিস্ময় নিয়ে বলেন অধ্যাপক ডা. মাহমুদা বলেন, ‘ছয়মাসে একটি হাসপাতালে কেবল আমরা এটুকু এন্ট্রি করতে পেরেছি, এর বাইরে রয়েছে অসংখ্য রোগী। সুতরাং, কোনও পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যায়-এটা বাড়ছে এবং খুব দ্রুতহারে বাড়ছে। এই ১০৩ জনের মধ্যে নারী ৫০ জন এবং বাকিরা পুরুষ। এবং এর মধ্যে খুব কমনসাইড হচ্ছে গালে এবং ডান দিকের গালে।’
ডা. মাহমুদা আক্তার আরও বলেন, ‘অভিজ্ঞতায় দেখেছি এসব রোগীর মধ্যে বেশিরভাগ রোগীরাই হচ্ছেন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সমাজের মানুষ। পান, সুপারি, জর্দা, চুন এটাই প্রধান কারণ। তবে এরসঙ্গে আরও অন্যান্য কারনও রয়েছে। আমাদের দেশে খুব কমন হচ্ছে, পান-চুন-সুপারি। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আয়োজন করে পান-চুন-সুপারি রাখা হয়। কিন্তু এর ভয়াবহতা সর্ম্পকে আমরা সেভাবে জানি না।’
চিকিৎসার জন্য ক্যান্সারাক্রান্ত রোগীদের জন্য তিনটি প্রধান অন্তরায় হিসেবে অধ্যাপক ডা. মাহমুদা আক্তার প্রথমত নিজেদের ক্যান্সারাক্রান্ত হবার বিষয়টি রোগীদের না জানা, দ্বিতীয়ত-কোথায় চিকিৎসা নিতে হবে সে সর্ম্পকে না জানা এবং তৃতীয়ত জানার পর আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসা না করাতে পারা অন্তরায় বলেন অধ্যাপক ডা. মাহমুদা আক্তার।
‘আমরা যদি শুরু থেকে প্রতিরোধ করতে পারি পুরোটা না হলেও অর্ধেকটা কমিয়ে আনতে পারবো তবে এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। জর্দা না খাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে তাদের সচেতন করতে পারি তাহলে মুখের ক্যান্সারের হার অনেক কমে আসবে। একইসঙ্গে জানানো দরকার, মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা কোথায় হয়, সে সর্ম্পকেও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে, মানুষকে জানাতে হবে’, বলেন তিনি।
একই কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ওরাল ক্যান্সার সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ। ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে মুখের ক্যান্সারের হার বেশি। তবে দেশে মুখের ক্যান্সারের হার কতো সে বিষয়ে কোনও জরিপ না হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ বা অন্যান্য দেশের জরিপ থেকে একটা আনুমানিক ধারণা হচ্ছে উপমহাদেশে মুখের ক্যান্সারের হার হচ্ছে শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ।’
তিনি বলেন, ‘আর এর কারণ হচ্ছে, ধোঁয়াবিহীন তামাক, যেমন সাদাপাতা, জর্দা, গুল, খৈনি এমনকি সুপারিও মুখের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। এছাড়াও, মুখের ভেতরের হাইজিন সর্ম্পকে ধারণা কম, আনহাইজেনিক তীক্ষ্ণ দাঁতের কারণেও ভেতরে ঘা হয়ে ক্যান্সার হতে পারে। হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাসও এখন মুখের ক্যান্সারে ভূমিকা রাখে। এসব থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারলেই মুখের ক্যান্সার কমে যাবে।‘
তবে মুখের ভেতর ঘা হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে জানিয়ে ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, ‘পরীক্ষা করতে হবে মুখের ক্যাান্সার হবার ঝুঁকি রয়েছে কিনা। যদি আর্লি ডিটেকশন করা যায় তাহলে কিন্তু তা প্রতিরোধ করা যায়।’
তবে বেশিরভাগ রোগীকেই লেট স্টেজে পাচ্ছি মন্তব্য করে ডা. সাখায়াৎ বলেন, ‘শুরুতে তারা বিকল্প চিকিৎসকদের কাছে যান, আবার কেউ যান না। শুরুর দিকে মুখের ক্যান্সারের রোগী নির্ণয় করা গেলে কেবল সার্জারি করেই এ রোগ থেকে সর্ম্পূণ নিরাময় সম্ভব। এটা আশার কথা। তবে পরে ধরা পরলেও রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি দিয়েও নিরাময় সম্ভব। তবে যতো দেরি হবে ততোই চিকিৎসার বাইরে চলে যাবে রোগী।’
একইসঙ্গে, মুখের ক্যান্সারের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল, চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়াতে মুখের ক্যান্সার বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে দেশে, বলেন ডা. সাখাওয়াৎ হোসেন সায়ন্থ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালগুলোতে মুখের ক্যান্সারের রোগীরা যখন আসেন তখন তারা এমনিতেই আসেন লেট স্টেজে, বেড সংখ্যা অপ্রতুল বলে ভর্তি নেওয়া সম্ভব হয় না। তখন রোগীদের সিরিয়ালে রাখতে গিয়ে রোগটা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যায়, শুরুর দিকে চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো যে রোগী সুস্থ হয়ে যেতেন; বেড দিতে না পারার কারণে তার চিকিৎসা শুরু হয় দেরিতে এবং তার সুস্থ হওয়ার হার কমে যায় অথবা সার্জারি করার মতো অবস্থায় থাকে না। কারণ, মুখের ক্যান্সারের জন্য মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি কেবল বিএসএমএমইউ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ এবং জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালেই হয়ে থাকে।
সারাবাংলা/জেএ/এমও