‘আমি কি ভুলিতে পারি’…
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০৩
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’— না, বাঙালি জাতি ভোলেনি পূর্বপুরুষের মহান আত্মত্যাগে ভাস্বর ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি’ দিনটিকে। গত ৬৬ বছর ধরে বিনম্র শ্রদ্ধায়, পরম মমতায়, স্বমহিমায় পালন করে আসছে দিনটি। আর ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মৃাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে ২১শে ফেব্রুয়ারি। আজ বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বাঙালি জাতির সেই মহান গৌরবের দিন।
ভাষার জন্য জীবন দানের ৬৭ বছর পূর্ণ হল আজ। বাঙালি জাতির জন্য এই দিনটি একদিকে যেমন শোকের ও বেদনার, অনদিকে তেমনি মাতৃভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মহিমায় ভাস্বর একটি দিন।
যেকোনো জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার। অর্থাৎ মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদরা জাতিকে সেই মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।
রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলার ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ-রাঙ্গানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। শহীদ হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক। বাঙালি জাতীর আত্মত্যাগের ইতিহাসে যোগ হয় আরেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
তাদের এই আত্মদান নিয়ে সরদার ফজলুল করিম তাঁর ‘বায়ান্নর আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘বরকত-সালামকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত-সালাম আমাদের ভালোবাসে। ওরা আমাদের ভালোবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।…আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে: তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা, বরকত-সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’
বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে লিখেছেন ‘মাতৃভাষার দাবি স্বভাবের দাবি। ন্যায়ের দাবি, সত্যের দাবি- এ দাবির লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোনো আপস চলে না, চলে না কোনো গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।’
ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন ‘মাতৃভাষার’ মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নব প্রেরণা। এরই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ- ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বুক চিতিয়ে মহান গৌরবের সঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালন করে আসছিল বাঙালি জাতি। ১৯৯৯ সালে বাঙালি জাতির এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সে বছর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়।
দিবসটি উপলক্ষে একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর একে একে জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধান বিচারপতি শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তাদের শ্রদ্ধা জানানো শেষ হলে সর্ব সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
ভোর ছয়টাও প্রভাত ফেরির মিছিল নিয়ে ফুল দিতে আসবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গসহ সর্বস্তরের লোকজন। পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে তারা ভাষা শহীদদের।
দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ভাষা শহীদদের স্মরণে সভা-সেমিনার রয়েছে এসব আয়োজন। পৃথক বাণীতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন।
সারাবাংলা/এজেড/এমআই