জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বার বার। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ নিয়ে অসংখ্যবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, মেডিকেল শিক্ষার মান নিয়ে কোনো আপস করা হবে না। আর বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে যা পড়ানো হচ্ছে তাতে ‘মানহীন চিকিৎসক’ গড়ে উঠছে।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এভাবে দুর্বল চিকিৎসক গড়ে উঠলে ভবিষ্যতে দেশের স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা থাকবে না।
তারা বলছেন, কেবল মুনাফা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ তৈরি করে এখানে ব্যবসা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে মোট একশটির মতো মেডিকেল কলেজ রয়েছে, যার মধ্যে ৩১টি সরকারি এবং ৬৯ টি বেসরকারি। প্রতিবছর সরকারি মেডিকেল কলেজে ৩ হাজার ৩২০ জন এবং বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ৬ হাজার ২০৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। অপরদিকে, ছয়টি সরকারি ডেন্টাল কলেজে ৫৩২ জন ও ২৬ টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয় ১ হাজার ৪০০ জন শিক্ষার্থী।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মানহীনতার কারণে গত ১৮ জানুয়ারি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালাকে আইনে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
এ নীতিমালা যথাযথভাবে পূরণ না করায় ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের জন্য কয়েকটি কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় রিভিউ করার প্রস্তুতি নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, মেডিকেল কলেজ নীতিমালা না মানায় সাফেনা উইমেন্স ডেন্টাল কলেজ, নর্দান মেডিকেল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, আইচ মেডিকেল কলেজ, সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ, কেয়ার মেডিকেল কলেজ এবং কেরানীগঞ্জের আদ্বদীন বসুন্ধরা মেডিকেল কলেজে এ ভর্তি স্থগিত করে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রটি জানায়,বেসরকারি মেডিকেল কলেজ গুলোতে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে দেখা গেছে,কয়েকটি কলেজে মানসম্মত হাসপাতাল নাই, হাসপাতালে পর্যাপ্ত শয্যা এবং লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরি নাই। এমনকি পর্যাপ্ত শিক্ষক নাই। আবারও কোনো কোনো কলেজে পূর্ণাঙ্গ ভবনও নাই।
আর এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের মানহীন কলেজগুলো কোনো না কোনো উপায়ে যদি ছাত্রছাত্রী ভর্তি কার্যক্রম শুরু করার সুযোগ পায়, তবে ভালো মানের চিকিৎসকও আর পাওয়া যাবেনা। তাই সরকারের এই কঠোর পদক্ষেপকে সহায়তা করার জন্য মন্ত্রী সবার সহায়তা চান।
ভালোমানের চিকিৎসক না পাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর একটি গবেষণা থেকেও। বিআইডিএস বলছে, এসব মানহীন মেডিকেল কলেজ থেকে তৈরি হচ্ছে মানহীন চিকিৎসকও।
এমনকি সম্প্রতি সংসদ অধিবেশনে মানহীন মেডিকেল কলেজগুলোকে পাঠদানের অনুমোদন দেওয়াতে আদালতের সমালোচনা করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। একইসঙ্গে তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ব্যবস্থা করে দেওয়াতে আইনজীবীদেরকে কঠোর সমালোচনা করেন।
গত ২১ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাসের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মেডিকেল শিক্ষার বিষয়ে কোনও কম্প্রমাইজ করা যাবে না বলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। অথচ এসব মেডিকেল কলেজ টাকার বিনিময়ে বড় বড় আইনজীবী ধরেছে, তারা আদালতে মিথ্যা কথা বলে কলেজগুলোর অনুমোদনের ব্যবস্থা করেছেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অনুযায়ী, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ক্ষেত্রে ৫০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজে ২৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতাল থাকা বাধ্যতামূলক। এসব হাসপাতালের ৭০ শতাংশ শয্যায় রোগীও থাকতে হবে। ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য থাকতে হবে ১১ জন শিক্ষক, একশ শিক্ষার্থীর জন্য ১৫, দেড়শ শিক্ষার্থীর জন্য ১৯ এবং দুইশ শিক্ষার্থীর জন্য ২৪ জন শিক্ষক থাকা বাধ্যতামূলক। মেডিকেল কলেজগুলোতে এসব শর্ত পূরণ হচ্ছে না। এসব কলেজে নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি। অথচ কলেজগুলো থেকে প্রতিবছর ছয় হাজারের বেশি চিকিৎসক পাস করে বের হচ্ছে বলে বিআইডিসি তাদের গবেষণায় উল্লেখ করেছে।
বিআইডিসির গবেষণা দলের সদস্য ড. রাইসুল আউয়াল জানান, বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং হাসপাতাল না থাকার পরও শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। এসব মেডিকেল কলেজগুলোর হাসপাাতলে রোগী না থাকার কারনে শিক্ষার্থীরা হাতে কলমের শিক্ষাটা পাচ্ছে না। অথচ, যে কোনও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেতে হলে হাসপাতাল এবং সেখানে রোগী থাকা বাধ্যতামূলক।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্ববায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব সারাবাংলাকে বলেন, দেশে একের পর এক মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হচ্ছে, অথচ সেখানে শিক্ষক নেই, যন্ত্রপাতি নেই, হাসপাতালগুলোতে রোগী নেই। তাহলে এসব শিক্ষার্থীরা শিখবে কোথায়। মানহীন এসব মেডিকেল কলেজগুলো নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না। বরং, এসব মেডিকেল কলেজেগুলোর বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানাধরণের অভিযোগ শুনতে হয়। কিন্তু এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশ মেধাবী কোনও চিকিৎসক পাবে না, দেশের স্বাস্থ্যসেবায় দেশের মানুষের অনাস্থা আসবে-তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারের কঠোর হওয়া ছাড়া কোনও পথ নেই।
সারাবাংলা/জেএ/টিএম