মেয়র হওয়ার স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন ছালাম
২০ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদায়ী মতবিনিময়ে এসেছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রথম রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান মো. আবদুচ ছালাম। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল- আরও বড় পদে বা চট্টগ্রামের মেয়র হওয়ার ইচ্ছা আছে কি-না ? জবাবে ছালাম বলেন, সেটি নির্ভর করছে নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী) ওপর।
শনিবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর ওআর নিজাম রোডে নিজের মালিকানাধীন ‘ওয়েল পার্ক’ আবাসিক হোটেলে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন ছালাম। ২২ এপ্রিল সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুচ ছালামের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আবদুচ ছালাম বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক কর্মীর স্বপ্ন থাকে এমপি হবেন, মন্ত্রী হবেন, উপজেলা চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর হবেন। আমিও এমপি হতে চেয়েছিলাম, সেজন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি কারণে আমাকে সিডিএ’র চেয়ারম্যান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, আমি জানি না। সিডিএর জন্য আমি অনভিজ্ঞ ছিলাম, কিন্তু এত বিশাল জায়গায় তিনি কেন আমাকে বসিয়েছিলেন, সেটা তিনিই জানেন।’
চট্টগ্রামের মেয়র হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ যতদিন বাঁচে ততদিন স্বপ্ন দেখে। তবে আমি যে সিডিএর চেয়ারম্যান হব, এমন কোনো স্বপ্ন আমার ছিল না। সুযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন যে দায়িত্ব পাব, সেই দায়িত্ব পালন করে যাব। কারও পছন্দ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে কোনো পদ পাওয়া যায় না। এটি জনগণের ম্যান্ডেট এবং সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী) ইচ্ছা, আমি মেয়র হবো কি-না, সেটি আমার নেত্রী কি চান সেটার ওপরই নির্ভর করছে। সুযোগ আসলে আলহামদুলিল্লাহ, সুযোগ না আসলেও আলহামদুলিল্লাহ। আমার কোনো বেদনা নেই।’
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন ছালাম। কিন্তু আসনটি তখন জাসদের মঈনউদ্দিন খান বাদলকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর আরও দুটি নির্বাচনেও বাদলই ওই আসনে ধরে রাখেন নৌকার হাল। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে মেয়র হিসেবে মনোনয়ন পাবার তোড়জোড় শুরু করেছিলেন ছালাম। কিন্তু মনোনয়ন পেয়ে মেয়র হন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।
তবে এরপর থেকে নাছিরের পরিচালনাধীন সিটি করপোরেশন এবং ছালামের পরিচালনায় থাকা সিডিএর মধ্যে দৃশ্যমান দূরত্ব তৈরি হয়। নগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ঘরোয়া সভায় দুই নেতার বাকবিতণ্ডার খবরও আসে গণমাধ্যমে। এর মাঝেই আকস্মিকভাবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দুই নেতা পাশাপাশি বসে ঐক্যবদ্ধভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়নে কাজ করার ঘোষণা দেন। দলের মধ্যে আলোচনা ছিল, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে মনোনয়নের আশায় ছালাম বসেছিলেন নাছিরের পাশে। কিন্তু এবারও বিফল হন ছালাম। সংসদ নির্বাচনের পর আবারও দুই মেরুতে চলে যান দুই নেতা।
২০২০ সালে অনুষ্ঠিতব্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে লড়তে আবদুচ ছালাম সিডিএর চেয়ারম্যান পদ ছাড়ছেন বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। তবে ছালাম জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে তিনি যখন নিয়োগ পেয়েছিলেন তখনকার সিডিএর আইন অনুযায়ী একই ব্যক্তির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্বের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর। একই আইন সংস্কার করে বর্তমানে মেয়াদ চার বছর কমিয়ে ছয় বছর করা হয়েছে।
‘আমার নিয়োগটা ছিল ইতিহাস। ৫০ বছরের ইতিহাস ভঙ্গ করে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সিডিএর চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। আমি চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য যে সুযোগ পেয়েছি, তা অনেকেই পাননি। ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল আমি যখন যোগদান করি, তার আগে আমি কল্পনাও করিনি, আমি সিডিএর চেয়ারম্যান হব। আমি কল্পনাও করিনি আমি ১০ বছর সুযোগ পাব। আমার নিয়োগ ছিল দুই বছরের জন্য। এরপর ছয়বার আমার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সিডিএর আইন অনুযায়ী একজন চেয়ারম্যানের মেয়াদ ছিল ১০ বছর। এখন ছয় বছর। সুতরাং আমি যতদিন মেয়াদ পেয়েছি, সেই সুযোগও আর কারও হবে না। সেদিক থেকেও আমি ভাগ্যবান।’
দায়িত্ব পালনকালে চট্টগ্রামের চারটি বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছেন বলেও জানিয়েছেন ছালাম। এগুলো হচ্ছে- জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসন, বিশ্বমানের পর্যটন শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তোলা।
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে ছালাম জানিয়েছেন, এইবছরও চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাবদ্ধতার কাঙ্খিত কোনো অগ্রগতি সম্ভব হবে না। তবে তিন-চার বছরের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হবে।
ছালাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর কাঙ্খিত স্বপ্ন এই বছরও পূরণ করা সম্ভব হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ঘোষণা দিতে চাই—আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে চট্টগ্রামবাসীকে জলাবদ্ধতার অভিশাপ স্পর্শ করতে পারবে না। সিডিএ ২৮টি স্লুইচগেট নির্মাণ করছে। মোট ৪১টি স্লুইচগেইট হচ্ছে। বাকি ১৯টি করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা না গেলে জলাবদ্ধতামুক্ত শহরের স্বপ্ন পূরণ করা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘চারটি সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ অর্থাৎ ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ আমরা করছি। বাকি কাজ করছে সেনাবাহিনী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। চারটি সংস্থার প্রকল্পগুলো পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত জলাবদ্ধতা দূর হবে না।’
যানজটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যানজট নিয়ে যত প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এবং যত প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে, সেগুলো শেষ হলে চট্টগ্রাম যানজটমুক্ত শহর হবে, চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্ন পূরণ হবে। পাঁচটি সম্পূর্ণ নতুন সড়ক করেছি, ১৪৩ কিলোমিটারের। ১০০ কিলোমিটারের মতো পুরাতন সড়ক সম্প্রসারণ করেছি।’
পতেঙ্গায় বিশ্বমানের পর্যটন নগরী গড়ার কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় এখন যা আপনারা দেখছেন তা মাত্র ১০ শতাংশ কাজ হয়েছে। বাকি ৯০ শতাংশ কাজ এখনও শুরুই হয়নি। সেটা শেষ হলে বোঝা যাবে, এই শহর আসলেই বিশ্বমানের পর্যটন শহর হয়েছে।’
নতুন চেয়ারম্যানের ওপর শতভাগ আস্থা আছে জানিয়ে ছালাম বলেন, ‘উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। যিনি শুরু করেন, তার পক্ষে সব কাজ শেষ করে যাওয়া সম্ভব হয় না। নতুন চেয়ারম্যান দোভাষ ভাই আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লোক। উনি শতভাগ সৎ মানুষ। আশা করি, উনি প্রমাণ করবেন- নেত্রী উনাকে চেয়ারম্যান করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি আমার কাজের মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করেছি।’
মতবিনিময়ের শেষদিকে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আবদুচ ছালাম। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জেনে না জেনে আপনাদের হয়তো অনেক কষ্ট দিয়েছি। হাতজোড় করে বলছি, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনারা আমার সব কর্মকাণ্ড ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।’
মতবিনিময়ের সিডিএর বোর্ড সদস্যদের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন ও হাসান মুরাদ বিপ্লব, স্থপতি আশিক ইমরান, কে বি এম শাহজাহান ও এম আর আজিমসহ আরও কয়েকজন ছিলেন।
সারাবাংলা/আরডি/এমআই