ভ্যাট আইন: অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আলাদা কর হার হচ্ছে
৩০ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:১০
ঢাকা: নতুন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আইনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এর মধ্যে টার্নওভার ট্যাক্স ও ভ্যাট অব্যাহতির সীমা বাড়ানো, ভ্যাট হারে পরিবর্তন, ভ্যাটের টার্নওভার ট্যাক্সের হার বাড়ানো এবং কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বিপরীতে ভ্যাট আদায়ে বিশেষ স্কিম চালু হচ্ছে।
ভ্যাটের হার বাড়লেও সকল পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে নিত্য প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া বা বিশেষ স্কীম চালু হবে। জ্বালানি তেল, ওষুধসহ বেশ কিছু পণ্য ও সেবার বিপরীতে ভ্যাট আদায়ের জন্য আলাদা একটি স্কিম প্রণয়ন করা হবে। নতুন এই স্কীম প্রণয়নে কাজ করছে এনবিআর। এটি এমন ভাবে করা হবে যাতে আবশ্যকীয় কিছু পণ্য ও সেবার দাম না বাড়ে। পেট্রোলিয়াম ও ওষুধ ছাড়া এ বিশেষ স্কিমে আরও নতুন নতুন পণ্য যোগ করা হবে বলে এনবিআরের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান।
এর আগে চলতি মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক প্রতিবেদনে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের আগে ‘নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার’ মূল্য নিয়ন্ত্রণে আলাদা করহার নির্ধারণে পদক্ষেপ নিতে অর্থ মন্ত্রনালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলো। একইসঙ্গে ভ্যাট আইন কার্যকরের পর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তার ওপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি বিশ্লেষণও তৈরি করা হয়েছে। এতে আগামী ১ জুলাই আইনটি বাস্তবায়নের আগে আলাদা করহার নির্ধারণ ছাড়াও আরও ৪টি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ( এনবিআর) পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব তথ্য জানান।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, আজ আমরা আমাদের স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠকে বসব। এরপরই ভ্যাট আইন চূড়ান্ত করা হবে। তিনি বলেন, আইনটি পরিবর্তন নিয়ে প্রাথমিক প্রস্তাবনা তৈরি করেছি, নতুন কিছু বিষয় থাকবে, বেশকিছু পরিবর্তন আসছে। ভ্যাট আইনকে সকলের উপযোগী করে পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ভ্যাট আইনে বার্ষিক টার্নওভারের সীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে টার্নওভার ট্যাক্স হারও বাড়ানো হচ্ছে। আগামী বাজেটে এ হার ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হবে। বর্তমানে এ হার ৩ শতাংশ। ফলে ৩ কোটি টাকার বেশি যাদের টার্নওভার রয়েছে তাদের ১ শতাংশ বেশি হারে ভ্যাট দিতে হবে। সাধারণত বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোরই ৩ কোটি টাকার বেশি টার্নওভার রয়েছে। তবে তিন কোটি টাকার নিচে যাদের বার্ষিক টার্নওভার রয়েছে, তাদের এ ট্যাক্স দিতে হবে না। তারা নতুন হারে ভ্যাট দেবে।
ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ বছরে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হলে ওই প্রতিষ্ঠানকে কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। মূলত ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের অধীনে যারা প্যাকেজ ভ্যাট দিতেন, তাদের ছাড় দিতেই অব্যাহতির সীমা বাড়ানো হচ্ছে। এর আওতায় পড়ে বেশির ভাগ ছোট ব্যবসায়ী। আগামী বাজেটেও ছোট ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আগের চেয়ে আরও একটু বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হচ্ছে। ফলে পাড়া-মহল্লা, ফুটপাত বা ছোট ছোট মার্কেটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভ্যাট দিতে হবে না।
নতুন আইনে বর্তমানে প্রচলিত ট্যারিফ ভ্যালু প্রথা থাকছে না। চালু হবে বাজারভিত্তিক ভ্যালু প্রথা। এর ফলে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বাড়বে। বর্তমানে এলপি গ্যাসের প্রতি কেজির ট্যারিফ ভ্যালু আছে ৩ টাকা। অর্থাৎ ৩ টাকার ওপর ভোক্তাকে ভ্যাট দিতে হয়। এ প্রথা ওঠে গিয়ে বাজারভিত্তিক প্রথা চালু হলে এর প্রকৃত উৎপাদন খরচের ওপর ভ্যাট বসবে।
নতুন আইনে ভ্যাটের ইউনিক হার ১৫ শতাংশই থাকছে। এ হারে যারা ভ্যাট দেবেন বছর শেষে চূড়ান্ত হিসাবে বাড়তি ভ্যাট দিয়ে থাকলে তারা রিবেট পাবেন। ভ্যাটের অন্য হারগুলো হবে ৫, সাড়ে ৭ ও ১০ শতাংশ। এ হারে যারা ভ্যাট দেবেন তারা কোনো রিবেট পাবেন না। নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা বিষয়ক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন আইনে অসাধু কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দিতে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ শিরোনামে একটি ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেটি প্রত্যাহার বা না রাখার সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। পাশাপাশি সতর্ক করে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ অটোমেশন কাজ শেষ না করে আইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এটি কার্যকরের আগেই ভ্যাট ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি অনলাইন করা দরকার।
প্রতিবেদনে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, আইনটি সম্পূর্ণ অটোমেশনের ওপর নির্ভর হলেও ভ্যাট নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল, অনলাইনে কর পরিশোধ, হিসাব সংরক্ষণ, চালান ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য বিষয়ে অটোমেশন কার্যক্রম শেষ হয়নি। এ অবস্থায় আইনটির বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন ১৫ ভাগ হারে ভ্যাট বিদ্যমান। নতুন আইনে সংকুচিত ভিত্তিমূল্য ও ট্যারিফ মূল্যের বিধান না থাকায় কতিপয় পণ্যের করহার বেড়ে মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন আইনে করযোগ্য পণ্য ও সেবার মূল্য ঘোষণা এবং সেটি মূসক কর্মকর্তা কর্তৃক নির্ধারণের ব্যবস্থা নেই। এতে কার্যকর নিরীক্ষা ও কর দায়িতা নিরূপণ কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থান ও পণ্যভেদে একত্রে হিসাব সংরক্ষণের শর্তে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ একই প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন পণ্য ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে সরবরাহ করলেও একত্রে হিসাব সংরক্ষণের শর্তে কেন্দ্রীয় নিবন্ধন নিতে পারবে। এরফলে কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হবে এবং কর ফাঁকির শঙ্কা থাকবে বলে মনে হচ্ছে।
এতে বলা হয়েছে, এ আইনে কর রেয়াতের সুযোগ অবধারিত করা হয়েছে। কিন্তু উপকরণ ক্রয় সংক্রান্ত চালানপত্র অনলাইনে দাখিল নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণের যথার্থতা যাচাই করা সম্ভব না-ও হতে পারে। এতে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। জাতীয় আয়ের অন্যতম ভিত্তি ভ্যাট উল্লেখ করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে রাজস্ব আয়ের প্রায় ৩৮ শতাংশ আসে ভ্যাট থেকে। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে ২০২১ সালের মধ্যে রাজস্ব আয় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা হতে হবে। কিন্তু ২০১২ সালের এ আইনটি নানা কারণে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে এটি কার্যকরের কথা থাকলেও ২ বছর পিছিয়ে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চালুর কথা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে আইনটি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, নিত্যপণ্য এবং সেবার ক্ষেত্রে সংকুচিত মূল্য ও বিধানের পরিবর্তে ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাট হার নির্ধারণ, ভৌগোলিক সীমার ভিত্তিতে মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১-এর অনুরূপ কেন্দ্রীয় ও ইউনিটভিত্তিক নিবন্ধন করা যেতে পারে।
করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, নতুন আইনে যেহেতু কর রেয়াতের সুযোগ অবধারিত করা হয়েছে। ফলে অনলাইনভিত্তিক চালানপত্র দাখিল নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে রেয়াত প্রদান অবারিত করা যাবে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইনভিত্তিক ভ্যাট আদায় হলে স্বচ্ছতা আসবে এবং অসাধু কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম কমার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকির প্রবণতা হ্রাস পাবে এবং বৃদ্ধি পাবে রাজস্ব আদায়। ভ্যাট আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কার ও প্রণোদনা নতুন আইনে কার্যকর করারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সারাবাংলা/এইচএ/জেএএম