পাহাড়ধস ট্র্যাজেডির একযুগ: প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় ক্ষোভ
১১ জুন ২০১৯ ২০:৪৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০০৭ সালের মর্মান্তিক ঘটনার ১৩ বছরেও পাহাড়ধস এবং প্রাণহানি প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রশাসনের প্রতি চরম ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে চট্টগ্রামে একটি নাগরিক স্মরণসভা থেকে। সেখানে বক্তারা বলেন, পাহাড়ধসে একজন মানুষের মৃত্যু হলেও সেটার জন্য দায়ী প্রশাসন। তারা পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদের নামে প্রতিবছর ‘ছেলেখেলা’ করে।
মঙ্গলবার (১১ জুন) সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এই নাগরিক স্মরণসভার আয়োজন করে পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েস, কারিতাস চট্টগ্রাম অঞ্চল ও বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)।
২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে নিহত ১২৭ জন ও ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙামাটিতে নিহত ১২০ জনের স্মরণে প্রতিবছর এই তিনটি সংগঠন যৌথভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। নিহতদের স্মরণে মোমবাতিও প্রজ্জ্বলন করা হয়েছে।
সভায় খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলি, কিন্তু যাদের শোনার কথা তারা শোনে না। প্রশাসনের কানের পর্দা কি নেই, আমাদের কথা কেন তারা শুনতে পান না ? যারা প্রশাসনের বিভিন্ন চেয়ারে বসে আছেন তারাও বলেন জনসেবার কথা, যারা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন তারাও বলেন জনগণের সেবার কথা। কিন্তু একযুগ ধরে মানুষের কথা তারা শুনবেন না, মানুষের আকুতি তাদের কাছে পৌঁছাবে না, এটা কেমন কথা! এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। যারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। মানুষ যখন জেগে উঠবে, তার চেয়ে বড় শক্তি আর কিছু নেই।’
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘গত ১২ বছরে আমরা ১২ বার এখানে দাঁড়িয়েছি। এই ১২ বছরে মাঝে ১-২ বছর বাদে প্রতিবছরই পাহাড়ধসে মানুষ মারা গেছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, প্রশাসন পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড গড়ার নেশায় আছে। ২০০৭ সালের মর্মান্তিক ঘটনার পর একটি কমিটি হয়েছিল- পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। আসলে এর নাম হওয়া উচিৎ ছিল কুম্ভকর্ণ কমিটি। প্রতিবছর বর্ষা এলে তাদের ঘুম ভাঙে আর একটি বৈঠক করে বিভিন্ন জ্ঞান বর্ষণ করে।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষা এলেই পাহাড়ে গিয়ে গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের লাইন কাটার নামে নাটক করে। অথচ সারাবছর পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পারে না। পাহাড়ের মাটি তো পকেটমারের মতো পকেটে কেটে নেওয়া যায় না। তাহলে প্রশাসনের চোখের সামনে কেন পাহাড় কাটা বন্ধ হয় না? কারা পাহাড়ে গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের সংযোগ দেয়? তাদের একজনেরও কি বিচার হয়েছে?’
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘চট্টগ্রামে ২০০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড়ধসে পড়ে। এটা প্রতিবছরই হয়। কিন্তু সারাবছর ধরে পাহাড়ে বসবাসরতদের প্রাণ রক্ষায় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। শুধু জুন-জুলাই এলেই পাহাড়ে গিয়ে নির্লজ্জ, বেহায়ার মতো বিদ্যুতের লাইন কাটে। সারাবছর তারা ছিল কোথায়? বর্ষা এলে কেন লাইন কাটে?’
সভাপতির বক্তব্যে পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, ‘২০০৭ সালে পাহাড়ধসের মর্মান্তিক প্রাণহানির পর পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি কিছু সুপারিশ দিয়েছিল। সেই সুপারিশের একটি বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা প্রতিবছর ১১ জুন কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন দাবিদাওয়া তুলে ধরি। আমাদের একটি দাবিও মানা হয়নি। আমরা প্রতিবছর বলে যাচ্ছি, কিন্তু তাদের শোনাতে পারছি না। এরপরও আমরা বলব- রাজনৈতিক ঐক্যমত্য ছাড়া পাহাড় রক্ষা হবে না, প্রাণহানিও বন্ধ হবে না।’
প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান বলেন, ‘যেসব প্রভাবশালী দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পাহাড়ে ঘর তুলে সেগুলো ভাড়া দেয়, তাদের প্রাণ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে একযুগেও তাদের বিচারের আওতায় আনতে না পারাটা লজ্জাজনক। এই লজ্জা রাষ্ট্রের, এই লজ্জা সমাজের। তারা কি তাহলে রাষ্ট্রের চেয়েও প্রভাবশালী? পাহাড় কাটা প্রতিরোধকে প্রশাসন এখন ছেলেখেলায় পরিণত করেছে।’
পিপলস ভয়েসের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আতিকুর রহমানের সঞ্চালনায় স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন কারিতাস চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক জেমস গোমেজ, পটিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাজেদা বেগম শিরু, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, সাংবাদিক আলোকময় তলাপাত্র ও শিক্ষিকা মার্গারেট ইউগিনিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা।
সারাবাংলা/আরডি/এমআই