বাবা, তুমি নেই ২২ বছর
১৬ জুন ২০১৯ ১৫:০৫
বাবা, তুমি নেই ২২ বছর। মানুষ ভাবে ২২ বছর অনেক সময়। অথচ আমার কাছে এটা তেমন কোনো সময়ই না। এই ২২ বছরে তুমি আমার কাছে আরও তরুণ হয়ে উঠেছো। বোহেমিয়ান আমি এবং আমার অগোছালো জীবন নিয়ে তোমার আক্ষেপ; কোনো এক পরীক্ষার আগে বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে তোমার কথা না বলা; পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে তোমার চোখের কোণে জমা পানি এবং আফসোস সব কিছুই আমার কাছে দিন দিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।
ছোটবেলায় তুমি ছাইপুকুরে নিয়ে গিয়ে আমার ছোট্ট বুকের নিচে হাত রেখে সাঁতারের প্রথম পাঠ দিয়েছিলে। সেই থেকে আমি সংগ্রাম-সাঁতারে আছি। তবে আমার ছোট্ট বুক তখনকার চেয়ে আরও অনেক চওড়া হয়েছে। আরো বেশি আবেগ এবং ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়েছে। তোমার হাতের স্পষ্ট ছাপ এখনও আমার বুকে দুর্বার সাহস জোগায়। এখনও আমি বুকের ভেতর মমতায় জড়ানো তোমার হাতের দশটি আঙুলের অস্তিত্ব টের পাই।
আমার শিক্ষার প্রথমপাঠ তুমিই দিয়েছিলে। শ্লেট আর কাঠখড়ি হাতে তুমি যখন আমাকে বর্ণমালার প্রথম পাঠ দাও তখন তোমার মনেও ছিল অন্যান্য বাবার মতো অনেক স্বপ্ন ও আশা। মদন মোহন তর্কালংকারের ‘শিশুপাঠ’ হাতে নিয়ে তুমিও তোমার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেছিলে। কিন্তু আমার কৈশোরের দুরন্তপনায় তুমি টের পেয়েছিলে তোমার স্বপ্ন অথবা আশা কোনোটাই আমি পূরণ করতে পারব না। সেই থেকে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসায় বোধ হয় বিষন্নতা ভর করেছিল। আর এই বিষন্নতা নিয়েই ২১ বছর আগে তুমি চলে গেলে। বিশ্বাস কর বাবা, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসায় বিষণ্ণতা না শ্রদ্ধা জমে আছে; জমে আছে আবেগ এবং আদর্শ। তোমার আদর্শ আজ আমার মাথার ওপর ছায়া হয়ে কাজ করে।
আমি তোমার স্বপ্ন ও আশার কতোটুকু পূরণ করতে পেরেছি জানি না। তবে তোমার স্বপ্ন যদি আকাশের সমান হয় তা আমি ছুঁতে পেরেছি। কারণ, তুমিতো আকাশ। আর এই আকাশ ঘিরেই আমার বসবাস। কোনোদিন তোমার হাতের আঙুল ধরে হেঁটেছি কিনা মনে নেই। তবে এখনও তুমি আমার হাত ধরে আছো বলে তলিয়ে যাইনি।
তুমি যখন মাথা নিচু করে হাঁটতে, তোমার পেছনে রাখা দু’হাতের বন্ধনে জড়িয়ে থাকতো সরলতা; তখন সেটা বুঝতে না পারলেও এখন পারি। এখন আমি সরল পথে তোমার জন্য সহজ হতে পারি। বাবা আজও তোমাকে মনে রাখি এবং মেনে রাখি। আগে তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে না পারলেও এখন পারি। আগে হয়তো গুটিয়ে যেতাম ভয়ের ভেতর।
এখন কিন্তু আমি অবলীলায় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তোমার কথা বলতে পারি। কখনও তুমি আমাকে তোমার বুকের ওমে জড়িয়ে ধরেছো কিনা মনে নেই। তবে আজও আমি তোমাকে জড়িয়ে আছি বাবা। তোমার সঙ্গে কোনোদিন পায়ে পায়ে হাঁটতে না পারলেও এখন মাঝে মধ্যেই তোমার মতো হাঁটার চেষ্টা করি। তুমি মানুষকে সহজ হতে বলতে। যুগ যন্ত্রণায় আমি কতোটা সহজ হতে পেরেছি জানি না। তবে তোমাকে যখন পড়ি তখন মনে হয় সরলতায় আমি কিছুটা সহজ হয়েছি।
আজ আমি যখন অস্পষ্ট জানালার কাঁচে দেখি নির্ঘুম অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে তখন আমার খুব ভয় করে বাবা। তোমার ঝাঁপসা পোট্রেট হাতে আমি কেবল আলোর দিকে যেতে চাই বাবা। আমার ছোট্ট বুকের বিহ্বলতা তোমাকে কোনোদিন দেখাতে পারিনি; তাই বলে কি তোমার উদাম বুকের উষ্ণতা আমি কখনো টের পায়নি? পেয়েছি বাবা। আজ আমাকে নরম আলোর দিকে নিয়ে ওই উষ্ণতায় একবার জড়িয়ে ধরবে বাবা….?