ডেঙ্গুর প্রকোপ, অসচেতনাকে দুষলেন দুই সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা
১২ জুলাই ২০১৯ ০১:৩২
ঢাকা: বর্ষার শুরুতেই ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গু মশার প্রকোশ। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রন শাখার তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘন্টায় শুধু রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩০ জন রোগী। আর গত ১১ দিনে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে এক হাজার পাঁচ শ ৪৬ জনে। যা গত পুরো মাসে আক্রান্তের সমান। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুও ঘটেছে। এতে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে নগরবাসীর জনজীবনে।
তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং রোগীর সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত হারে বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও এটির মূল কারণ হিসেবে জন সচেতনার অভাবকে দুষছেন ঢাকার দুই সিটির দায়িত্বশীল স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কিংবা প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হলেও শুধুমাত্র জনসচেতনার অভাবেই এটি নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না। আর এ কারণেই ক্রমেই অনিয়ন্ত্রিত হারে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে বলে দাবি করছেন তারা। তাই জনগণকে সচেতন হওয়ার জোর দাবিও জানাচ্ছেন তারা।
কিন্তু নগরবাসী বলছেন, জনসচেতনার উপর দায় চাপিয়ে দুই সিটি ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না। বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রনে সিটি করপোরেশন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এমনকি কোনো কোনো ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত দেড়–দুবছরে মশার ওষুধ তো দূরের কথা সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন কর্মীদেরও দেখা মিলে নি কালেভদ্রে। আবার কোথাও কোথাও একবার ওষুধ ছিটালেও দীর্ঘদিন ধরে আর ঔষুধ ছিটানোর কোনো লক্ষণ থাকে না। এসব কারণেই মশার উপদ্রব বেড়েছে এবং রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
এমনকি সিটি করপোরেশনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) সিটি করপোরেশন মশা নিধনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মেয়র ও নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর (ডিএসসিসি) ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি নোটিশও পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে সারাবাংলাকে বলেন, খিলগাঁও এলাকায় গত দুবছর ধরে শুধু আমি নয়, এলাকার কোনো বাসিন্দাও বলতে পারবে না যে তারা মশার ওষুধ তো দূরের কথা, মশা নিধন কর্মীদেরও এক নজর দেখেছে। তাহলে যেখানে মশা নিধন কর্মী নেই, মশার নিধনের ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। সেখানে মশার উপদ্রবে যদি কেউ রোগাক্রান্ত হয় তাহলে সে দায় কি জনসচেতনার দোহায় দিয়ে এড়ানো যাবে? কিন্তু সিটি করপোরেশন সে কাজটিই করছে।
শুধু এই আইনজীবীই নন, এমন অভিযোগ করেছেন রাজধানীর নন্দীপাড়া, জুরাইন, মিরপুর, ভাষানটেক, বাসাবো, শনির আখড়া, হাজারীবাগ ও বছিলার বাসিন্দারা। নন্দীপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল সাকিব সারাবাংলাকে বলেন, নিয়মানুযায়ী প্রতি একদিন দুদিন পর পর ঔষুধ ছিটানো তো দূরের কথা। মাসে একবারও যদি ঔষুধ ছিটানো হতো তাহলেও মনে হয় এমন হতো না। রাতের বেলা নয় শুধু, দিনের বেলাতেও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ আমরা। একই অভিযোগ করলেন জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ডিএসসিসির ৪২৯ জন মশক নিধন কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। তারা প্রতিদিন সকাল বিকাল দুইবার মশার ওষুধ ছিটানোর কাজ করে। তারা মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য সকালে লার্ভিসাইড এবং বিকালে অ্যাডাল্টিসাইড ওষুধ ছিটানোর কাজ করে।
এক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি নেই জানিয়ে তিনি আরও বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ডিএসসিসি যা যা করণীয় তা করার চেষ্টা করছে। বিশাল এলাকায় পর্যাপ্ত কর্মী না থাকলেও যারা আছে তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র জনসচেতনতার অভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আমরা স্বীকার করছি যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। কিন্তু সেটির জন্য অবশ্যই অসচেতনায় দায়ী। কারন আমাদের কর্মীরা বাসাবাড়ির বাহিরে ঔষুধ ছিটালেও নানা কারণে বাসাবাড়ির ভেতরে ওষুধ ছিটাতে পারছেন না। তাই বাসাবাড়ির ভেতরে তিনদিনের বেশি জমে থাকা টব, ফ্রিব কিংবা বাসার ছাদের পানিতেই ডেঙ্গু মশার বংশবিস্তার ঘটে। আর তাই আমরা চেষ্টা করছি জনসচেনতা বাড়াতে। এজন্য আমরা বিজ্ঞাপন, লিফলেট, সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচী বাস্তবায়ণ করে যাচ্ছি।
বাসিন্দাদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মশক নিধন কর্মীরা সব সময় ওষুধ ছিটানোর কাজ করে। তবে কেউ যদি তাদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেন তাহলে অবশ্যই সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
একই কথা বললেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ২৮০ জন কর্মী সকাল বিকাল ঔষুধ ছিটাচ্ছে ডিএনসিসির সব এলাকায়। কিন্তু জনসচেতনার অভাবে আমরা তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করতে পারছিনা। উন্নয়ন কাজে সড়কে কনস্ট্রাকশন কাজ হয়। সেখানে পানি জমে। এটাও একটা কারণ। আবার বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানিও একটা কারণ। তাই আমরা জনসচেতনতায় নানা কর্মসূচী করে যাচ্ছি।
ওষুধ ছিটালে কাজ হচ্ছে না কেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঔষুধ কাজ হচ্ছে না বলা যাবে না। কাজ ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু ওইযে আন্ডার কনস্ট্রাকশন এবং বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানির কারণেই তা পুরোপুরি কাজে আসছে না। কারণ সেসব জায়গায় তো ওষুধ ছিটানো যায় না। তাই সেসব স্থান থেকে সৃষ্ট মশা গুলোই দ্রুত বিস্তার ঘটায়। আর এ কারণে কিছুটা অনিয়ন্ত্রণে ডেঙ্গু মশার প্রকোপ।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সহকারি পরিচালক ডা. আয়েশা আজম সারাবাংলাকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে এতে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। সাবধানতা অবলম্বন এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করলে নিরাময় হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, জুন মাসে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৭৫১ জন। আর চলতি মাসের ১১ দিনে সেই সংখ্যা ১ হাজার ৫৪৬ জন। যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ ডেঙ্গুর প্রকোপটা সাধারণত আগষ্ট–সেপ্টেম্বরের দিকে হয়। কিন্তু চলতি বর্ষার আগেই শুরু হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপও আগে শুরু হয়েছে।
সারাবাংলা/এসএইচ/আরএসও
উত্তর সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গুর প্রকোপ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর