ডেঙ্গু প্রশ্নে আগাম বার্তা আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ
২৭ জুলাই ২০১৯ ২১:৪১
ঢাকা: বিগত ১৮ বছরের ইতিহাসে এবার ২০১৯ সালে এডিস মশার আক্রমণে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ বিষয়ে সরকারের কাছে আগাম সতর্ক বার্তা থাকলেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। উল্টো পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ আকারের দিকে যাচ্ছে তখন সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে আসছে অসংলগ্ন মন্তব্য। শেষ পর্যন্ত খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সংযত মন্তব্যের পরামর্শ দিয়েছেন।
সারাবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এবার এডিস মশার আক্রমণ ভয়াবহ হতে পারে এবং এতে নাগরিকদের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হার বাড়তে পারে। সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে গত এপ্রিলে এই বার্তা দিয়েছিল কীটতত্ত্ববিদ ও সংশ্লিষ্টরা। গত এপ্রিলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে ডেঙ্গু বিষয়ে সরকারকে আগাম সতর্ক বার্তা দিয়ে করণীয় সম্পর্কেও পরামর্শ দেয় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। অথচ এই বার্তাকে আমলে নেয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন।
এপ্রিলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও মশা গবেষক ড. কবিরুল বাশার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এর আগে ৩/৪ মাস স্বাস্থ্য অধিদফতরের নেতৃত্বে এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে একটি জরিপ করা হয়। জরিপ শেষে গত এপ্রিলে জরিপের ফলাফল জানানোর সময় তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে আমরা জানিয়েছি যে, ১৯৫৩ সালের পর চলতি বছরের (২০১৯) ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বছর এডিস মশার ব্যাপক আক্রমণ হতে পারে। যা থেকে নাগরিকদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। সেজন্য এখন থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ড. কবিরুল বাশার আরও বলেন, ‘ওই বৈঠকে সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরাও ছিল। এছাড়া আমাদের আগাম সতর্কবার্তা সিটি করপোরেশনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকেই জানানো হয়। পাশাপাশি আমাদের পরামর্শ বা আগাম কী প্রস্তুতি নিতে হবে সে বিষয়েও সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবগত করা হয়। কিন্তু সরকারের দিক থেকে এ বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে কিনা তা সরকারের প্রতিনিধিরা ভালো বলতে পারবেন।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এডিস মশা সাধারণত বাড়ি-ঘরের ভেতরে জন্মায়। এ জন্য বাড়ি-ঘরের পরিচ্ছন্নতা এবং সচেতনতা ছাড়া এডিস মশা প্রতিরোধ সম্ভব নয়।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজধানীতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই সিটি করপোরেশন প্রতিবারের মতো এবারও রুটিন কাজ করেছে। আগাম সতর্ক বার্তা অনুযায়ী বাড়তি গুরুত্ব বা এই বিষয়ে কার্যকর কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
চলতি জুলাইয়ে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে যখন ডেঙ্গু রোগীর ঠাঁই হচ্ছে না তখনও স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে ঢাকার মেয়ররা অসংলগ্ন মন্তব্য, এমনকি বিষয়টিকে গুজব বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। অবস্থা বেগতিক হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে ডেঙ্গু ইস্যূতে সরকারি প্রতিনিধি সকলকে সংযত মন্তব্যের পরামর্শ দেন।
অন্যদিকে, ডেঙ্গু যখন বিগত ১৮ বছরেরও রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়ছে তখনও সিটি করপোরেশন বা সরকারের সংশ্লিষ্টদের এই ভয়াবহতা প্রতিরোধে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে স্কাউট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। যা রোববার (২৮ জুলাই) থেকে শুরু হবে। অথচ এর আগেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে।
এই প্রতিবেদন লেখার সময় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বনানীতে বৈঠক করছিলেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের কাছে জানতে চাওয়া হয় যে ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বশেষ হালনাগাদ কোনো তথ্য আছে কিনা?’- জবাবে তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, ‘লেটেস্ট কোনো আপডেট নেই। আমাদের চলমান কর্মসূচিগুলো চলমান আছে। প্রতিদিনই আমরা কাজ করছি। কিন্তু বিস্তারিত আমার অফিসের লোকজন বলতে পারবে।’
এবার ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার নিতে পারে, সে বিষয়ে গত এপ্রিলে কোনো বিশেষ সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন কিনা, জবাবে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘হ্যাঁ, কিন্তু এপ্রিল-মে এই সময় এডিস মশার মৌসুম। এটা নতুন কিছু নয়। গত ২০/২২ বছর ধরে এটাতো প্রতিবারই হচ্ছে। এটাতো একটা রুটিন ওয়ার্ক।’
ওই সময়ে দেয়া আগাম বার্তা নিয়ে আপনারা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে দক্ষিণের মেয়র বলেন, ‘এটা রুটিন ওয়ার্ক, গত ২০ বছর ধরেই এ বিষয়ে কাজ চলছে। শুধু আমি না, আমার আগে যারা ছিলেন তারাও এই সময়ে ডেঙ্গুর বিষয়ে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন। বিষয়টা হচ্ছে, এবার ডেঙ্গু শুধু ঢাকার বিষয় না, এটা একটি বৈশ্বিক বিষয়।’
এদিকে মশা গবেষক ড. কবিরুল বাশার সারবাংলা’কে বলেন, ‘এডিস মশা প্রতিরোধে এই মুহূর্ত থেকে সম্মিলিতভাবে দুটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। একটি হলো মানুষের বাড়িতে চার দেয়ালের ভেতরে এবং বাড়ির বাইরের মশা দমনে কার্যকর ব্যবস্থা। পাশাপাশি জনগণের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি করা।’
ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘মানুষের বাড়িতে চার দেয়ালের ভেতরে মশা নিধনে আমাদের এই কর্মসূচি চলমান রয়েছে। আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত ৫৩ ওয়ার্ডের মোট ২৫ হাজার বাড়িতে স্প্রে করে দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। প্রতিদিন আমরা কমপক্ষে ১ হাজার ৭১০টি বাড়ি স্প্রে করছি।’
আরও পড়ুন:
ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে
ডেঙ্গুজ্বর যেন আল্লাহ আর কাউকে না দেয়: অর্থমন্ত্রী
সাড়ে ৩ লাখ ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক: সাঈদ খোকন
ডেঙ্গুর মহামারিতেও সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেই: রিজভী
ডেঙ্গু পরীক্ষায় অতিরিক্ত ফি নেওয়া হচ্ছে কিনা, জানতে চান আদালত
ডেঙ্গুকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি: স্থানীয় সরকারমন্ত্রী
ডেঙ্গুতে অসচেতনতা: ১৫ আবাসন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
ডেঙ্গু নিয়ে সরকারি তথ্যে গড়মিল!
গুজব ও ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন: পিএমও
একদিনে হাসপাতালে ৫৬০ ডেঙ্গু রোগী, শুধু ঢামেকেই ১৪৫
মশার ওষুধ কাজ করছে না দেখেই এত ডেঙ্গু রোগী: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
জুলাই মাসেই ঢামেকে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ৯১১, মৃত্যু ৩ জনের