বিশ্বাস করুন, আমার জীবনে কোনো কষ্ট নেই: শাবনূর
৩০ জুলাই ২০১৯ ১৮:৪৪
ঢাকাই ছবির তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা শাবনূর। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনি বড় একটি অধ্যায় জুড়ে আছেন। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে শুরু হয় তার চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ার। অভিনয় করেছেন অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবিতে। পেয়েছেন আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা।
শাবনূর এখন সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। পেয়েছেন নাগরিকত্ব। সেখানে একমাত্র ছেলে আইজান ও পরিবার নিয়ে দিব্যি সময় কাটছে তার। মাঝে মধ্যে দেশে আসেন, প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার উড়াল দেন অস্ট্রেলিয়া।
চলতি বছর শাবনূর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে ২৬ বছরে পূরণ করতে যাচ্ছেন। যদিও আজকাল তিনি সিনেমায় অনুপস্থিত। তবে শাবনূর তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার, বাংলা চলচ্চিত্র, পছন্দের পরিচালক, জুটি আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন সারাবাংলার সঙ্গে।
স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়া থাকছেন। নিরাপদ জীবন যাপনের জন্যই কী অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হলেন?
অনেকটা সেরকম বলা যায়। মূলত আমি আমার একমাত্র ছেলের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছি। সে যেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সেজন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকছি। তবে এটা ঠিক, এখানে জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত। নিরাপদ জীবন যাপন করা যায়। শুনতে খারাপ লাগলেও, এখানে যেরকম নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাই সেরকম সুযোগ সুবিধা বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। তাই বলে এটা নয় যে, আমার বাংলাদেশ খারাপ। আজকে আমি বাংলাদেশের আলো বাতাসে বড় হয়েছি। সেখানকার দর্শকের কারণে আমি নায়িকা হয়েছি। অস্ট্রেলিয়া থাকছি ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশ সবসময় অন্তর জুড়ে থাকে।
ইন্ডাস্ট্রিতে আড়াই দশক পার করে দিলেন। এই এত বছরের ক্যারিয়াকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নিজের মূল্যায়ন তো আর নিজে করা যায় না। মানুষ করবে আমার মূল্যায়ন। তবে আমি যদি নিজেকে মূল্যায়ন করি তাহলে বলব, আমি আমার ক্যারিয়ারে ভালো ভালো কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। সেসব ভালো কাজ মানুষ পছন্দ করেছে বলেই আজকে আমি শাবনূর হয়েছি।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন। সেসব পরিচালকের মধ্য আপনার পছন্দের পরিচালক কারা ছিলেন?
হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান না হলেও গুরুত্বপূর্ণ, তেমন আমার ক্যারিয়ারে সব পরিচালকই গুরুত্বপূর্ণ। আমার শাবনূর হওয়ার পেছনে সব পরিচালকের ভূমিকা আছে। আমি যাদের ছবিতে অভিনয় করেছি তারা সবাই আমার মাথায় হাত দিয়ে ‘মা’ ডেকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কাজ করিয়েছেন। সেটে বুঝতামই না যে, এটা সেট নাকি বাসা! আমি সবসময় আমার পরিচালকদের শ্রদ্ধার চোখে দেখেছি।
যদি নির্দিষ্ট করে কোনো পরিচালকের নাম জানতে চান তাহলে বলব, শাহ আলম কিরণ, আমজাদ হোসেন ও মতিন রহমান আমার পছন্দের। শিবলী সাদিক, আজাদী হাসনাত ফিরোজ, মোস্তাফিজুর রহমান মানিক ছাড়াও বেশ কয়েকজন পরিচালক আমার পছন্দের তালিকায় আছেন।
আরও পড়ুন : ডেঙ্গু আক্রান্ত চিত্রনায়ক আলমগীর শঙ্কামুক্ত
সালমান শাহর সাথে আপনার জুটি সেরা, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই এই জুটিকে পাশে সরিয়ে জানতে চাই, সালমান শাহ পরবর্তী কোন জুটি ব্যক্তি শাবনূরের কাছে প্রিয়?
রিয়াজ ও ফেরদৌসের সাথে জুটি হয়ে অনেক ছবিতে কাজ করেছি। এই দুই জনের সাথে আমার জুটিটা পছন্দের। এছাড়া অমিত হাসান, ওমর সানি এবং সবশেষ শাকিব খানের সাথে জুটি হয়ে কাজ করেছি। তাদের সাথের জুটিও আমার কাছে প্রিয়। তবে আমি রিয়াজ আর ফেরদৌসকে এগিয়ে রাখব।
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শাবনূর। ছবি: শাবনূর
সারাবাংলা’র একটি সাক্ষাৎকারে রিয়াজ বলেছিলেন যে, পলিটিক্সের কারণে রিয়াজ–শাবনূর জুটি ভেঙে গেছে। আসলে কী তাই?
আমার কাছে তা মনে হয় না। এখানে পলিটিক্সের কোনো প্রশ্নই আসে না। একটা জুটি সারা জীবন থাকে না। নতুন নতুন জুটি তৈরি হয়। আর এক জুটিকে মানুষ সবসময় পছন্দ করবে এটাও না। রিয়াজের সাথে পরবর্তী সময়ে আমার সিনেমা প্রস্তাব আসেনি বলেই হয়ত ছবি করা হয়নি। এটা আসলে পরিচালকদের বিষয়। তারাই ভালো বলতে পারেন, কোন চরিত্রে কাকে মানাবে।
অনেকে আমাকে দোষারোপ করেন যে, আমার কারণে নাকি অনেকে অনেক ছবিতে অভিনয় করতে পারেননি। এটা আসলে একদম ভুল। আমি কারও ছবি করতে না পারার জন্য দায়ি নই।
একটা বিতর্ক প্রায় শোনা যায়, শাবনূরের কাঁধে ভর করে নিজের জায়গা পোক্ত করেছেন রিয়াজ ও ফেরদৌস…
এটা একদমই ঠিক না। আমার প্রজন্মের সব থেকে স্মার্ট নায়ক রিয়াজ ও ফেরদৌস। তাদের কথা বলার ধরন, আচরণ—সবকিছুই আকর্ষনীয়। তারা সিনেমায় নিজের যোগ্যতা দিয়েই আজকের অবস্থানে এসেছেন। তারা দুজন অসম্ভব মেধাবী। অভিনয় ছাড়াও তারা দারুণ উপস্থাপনাও করেন।
তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে পরিচালক এসে আমার কাছে জানতে চাইতেন, ছবিতে নায়ক হিসেবে কাকে নেয়া যায়—আমি তখন রিয়াজ বা ফেরদৌসের নাম বলতাম। এর একমাত্র কারণ, তাদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ভালো। কাজের ক্ষেত্রে প্রচুর হেল্পফুল তারা।
ক্যারিয়ারে কোনো চরিত্রে অভিনয় নিয়ে আক্ষেপ আছে?
একজন অভিনয়শিল্পীর ভালো চরিত্রে অভিনয় করার ক্ষুধা থাকে আজীবন। যখন ক্ষুধা থাকবে না তখন শিল্পী মারা যাবেন। অনেক চরিত্র আছে যেগুলো আমি করতে পারিনি। এখনো ইচ্ছা জাগে স্বপ্নের কিছু চরিত্রে অভিনয় করতে।
ছোট পর্দায় অনীহা কেনো?
ছোটপর্দায় কখনো অনীহা ছিল না। আমি সবসময় ছোট পর্দা ভালোবাসি। অনেকবার ছোটপর্দায় কাজ করতে চেয়েছি। সময়ের কারণে করা হয়ে ওঠেনি। সিনেমা নিয়েই দম ফেলার সময় ছিল না। ছোট পর্দায় কাজ না করার আরেকটা বড় কারণ হলো, বড় পর্দায় নিজেকে রানী মনে হয়। তাছাড়া, মানুষ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমা হলে যায়। ছোট পর্দায় সেটার দরকার হয় না। মানুষ বিনামূল্যে দেখতে পারে।
আরও পড়ুন : টিকিটের মূল্য এবং সিনেমা হল নিয়ে কাজ শুরু করবে প্রযোজক সমিতি
সিনেমা পরিচালনা করার ইচ্ছা আছে?
অস্ট্রেলিয়াতে সিনেমা বানাতে চাই। প্রযোজক বারবার সিনেমা বানানোর কথা বলছেন। আমার ছেলের কারণে করা হয়ে উঠছে না। আমার পুরো মনোযোগ এখন ছেলের দিকে। ওকে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই।
দেশের চলচ্চিত্র ক্রান্তিকাল পার করছে। এসময় আপনার কী উচিত নয় পাশে দাঁড়ানো?
আমি একা কীভাবে চলচ্চিত্রের ক্রান্তিকাল পার করব? একার পক্ষে সব কাজ তো সম্ভব না। দেশে ভালো শিল্পী নেই, ভালো চিত্রনাট্যকার নেই। শুধু তাই না, সিনেমা হলের অবস্থাও ভালো না। অনেক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আমি যদি সিনেমা বানাই তাহলে প্রযোজক তো লাভের মুখ দেখবেন না।
সিনেমার ব্যবসার মূল ভরসা গ্রামের মানুষ। গ্রামের হলগুলো হাউজফুল গেলেই সিনেমা হিট হয়। সেই গ্রামের মানুষ এখন সিনেমা দেখে না। তারা পাশের দেশের সিনেমা দেখছে। আপনি চিন্তা করুন, যে কলকাতা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে ছিল তারা এখন আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। ভাবা যায়! আমাদের সবাইকে একসঙ্গে ছবির উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ এগিয়ে আসলে উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শোনা যায়, ঢাকাই সিনেমায় শিল্পী সংকট চলছে। আপনি কী তাই মনে করেন?
শিল্পী অনেক আছে। কিন্তু তাদের কাজে লাগাতে পারছেন না। এই যে রিয়াজ, ফেরদৌস কাজ করছেন না। অথচ তাদের নিয়ে সুন্দর ছবি নির্মাণ করা সম্ভব। পরিচালকদের মধ্যে সেই রুচিবোধটা থাকতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মধ্যবয়সি নায়করা ব্যবসা সফল ছবি উপহার দিচ্ছেন। তাদের নিয়ে পরিচালক ছবি বানাচ্ছেন। একমাত্র আমাদের দেশে ব্যতিক্রম দেখি।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। নিজের একটি ভালো ও খারাপ গুণ জানতে চাই, যা সবাই জানে না।
আমার ভালো গুণ হলো, আমি কারো সমালোচনা করি না। কারও পেছনে কথা বলি না। কেউ যদি বিশ্বাস করে কোনো কথা আমাকে বলে অন্যকে না বলার শর্তে, আমি কখনো সেকথা ফাঁস করি না। এছাড়া আমি মানুষের প্রতি দয়াশীল। মানুষের কষ্ট আমি দেখতে পারি না। আর খারাপ গুণ হচ্ছে, আমি গুছিয়ে কাজ করতে পারি না। হুটহাট করে কাজ করি। প্ল্যান করে কাজ করি না।
সবথেকে কষ্টের সময়…
বিশ্বাস করুন, আমার জীবনে কোনো কষ্ট নেই। আমি কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে, কষ্ট পাওয়ারই সময় পাইনি। আমার মা, ভাই বোন সবসময় আমার সাথে ছায়ার মত ছিলেন। তারা আমাকে কষ্টটা বুঝতে দেননি।
শেষ কবে কেঁদেছেন?
যখন আইজান (ছেলে) আমার পেটে তখন আমি খুব চিল্লাচিল্লি করতাম। রাগে কান্নাকাটি করে বলতাম, কেন বিয়ে করলাম? কেন বাচ্চা নিলাম? তখন সবশেষ কান্নাকাটি করি। তারপর আইজান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মা বললেন, এখন কেমন লাগে? তখন বলেছিলাম, এরচেয়ে শান্তি আর পৃথিবীতে নেই।
শাবনূর ও তার ছেলে আইজান নেহান। ছবি: শাবনূর
নায়িকা না হলে কী হতেন?
আমি তো পাইলট হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমাকে নায়িকা বানিয়েছে। নায়িকা হয়ে আমার ভালোই হয়েছে। আমি অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি।
ছেলে যদি নায়ক হতে চায়…
আগে তো আইজান বড় হোক। তারপর সে যদি মনে করে নায়ক হবে, তো হবে। যদি অন্যকিছু হতে চায় তাতেও আপত্তি নেই। বড় হয়ে আইজান যে পেশাই বেছে নিক না কেন; আমি সবসময় তাকে ভালো মানুষ হতে বলব।
অস্ট্রেলিয়ায় সময় কাটছে কীভাবে?
এখানে নিজের কাজ নিজের করতে হয়। বাংলাদেশের মতো কাজের লোক পাওয়া যায় না। সেজন্য নিজের কাজ নিজে করতে গিয়ে সময় চলে যায়। তাছাড়া আমি এখানে ‘জুম্বা’ ক্লাস করছি। ‘জুম্বা’ এক ধরনের ড্যান্স। এসব করেই দিন কেটে যাচ্ছে। সামনে আরও কিছু কোর্সে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা আছে।
শাবনূর অনেক মুটিয়ে গিয়েছেন। আগে এমন ছিলেন না। এখন যখন আপনি আপনার আগের সিনেমার ক্লিপ দেখেন তখন কী আফসোস হয়?
মোটই আফসোস হয় না। তখন সেই বয়সে যেমন থাকার কথা ছিল তেমন ছিলাম। এখন এই বয়সে যেমন থাকার কথা তেমন আছি। আমি এমনিতেই প্রচুর খাবার খাই এখন। বিরিয়ানি, বার্গার—সব। অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর আমি প্রতিদিন রেস্তোঁরাতে যাই আর বিভিন্ন স্বাদের খাবার খাই। সিনেমায় অভিনয় করার সময় স্লিম থাকার জন্য যেসব খাবার খেতে পারিনি সেসব এখন খাচ্ছি। সব পুষিয়ে নিচ্ছি। হা হা হা।
আরও পড়ুন :
. শাফিন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে মাইলসের ১০ কনসার্ট
. ‘অবতার’ ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন গোবিন্দ!
. মুখ খুললেন আনুশকা
. নতুন নায়িকা নিয়ে শাকিব খানের ‘আগুন’ মিশন
. শকুন্তলা নাট্যপ্রযোজনা: একটি নান্দনিক শিল্পপ্রয়াস
. চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়ায় সংস্কার প্রস্তাব