জব্দ হচ্ছে চট্টগ্রামের আ.লীগ নেতা মাসুমের ‘সেই’ অস্ত্র
২ আগস্ট ২০১৯ ২২:১৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চট্টগ্রামের ‘বিতর্কিত’ আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুমের ব্যক্তিগত দু’টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ অস্ত্রগুলো জব্দের জন্য মাসুমের বাসায় গেলেও সেগুলো পায়নি। যে কারণে অস্ত্রগুলো থানায় জমা দেওয়ার জন্য বাসায় নোটিশ দিয়ে এসেছে পুলিশ।
শুক্রবার (২ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার লালখান বাজারের বাসায় অস্ত্র দু’টি জব্দে অভিযান চালায় পুলিশ।
দিদারুল আলম মাসুম নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মাসুম লালখান বাজারের চানমারি রোডের ইপিক কামারপার্ক নামে একটি ভবনের বাসিন্দা আবদুল হকের ছেলে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের লালখান বাজার ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর এ এফ কবির আহমেদ মানিক গত ২২ জুলাই মাসুমের নামে বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দ থাকা দু’টি অস্ত্রের (শটগান/৫৪৪৪/ডবলমুরিং ও পিস্তল/৩৩/খুলশী) লাইসেন্স বাতিলের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। ওই আবেদনে তিনি মাসুমকে চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী উল্লেখ করে তাকে ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। এছাড়া যুবলীগ নেতা রিপন ও মিজান এবং ছাত্রলীগ নেতা আবদুল মোমিন ও মুজিব হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততার তথ্য তুলে ধরা হয়।
মাসুমের বিরুদ্ধে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগ এনে কাউন্সিলর মানিক আবেদনে আরও উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে মাসুম বিদেশে পালিয়ে ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে হত্যা কিংবা হামলার শিকার হতে হয়।
এই আবেদনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চট্টগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে অস্ত্র দু’টির লাইসেন্স বাতিল করে জব্দের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৩১ জুলাই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লাইসেন্স বাতিল করে অস্ত্র দু’টি জব্দের বিষয়ে চিঠি দেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনারকে। সিএমপির বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মো.আব্দুল ওয়ারিশ খান বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অস্ত্র দু’টি জব্দের নির্দেশ দেন।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রনব চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাইসেন্স বাতিল হওয়া অস্ত্র দু’টি জব্দের জন্য আমরা দিদারুল আলম মাসুমের বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় তাকে পাওয়া যায়নি। অস্ত্রও পাওয়া যায়নি। মাসুমের ভাই আমাদের জানিয়েছেন, তিনি চট্টগ্রামের বাইরে আছেন। আমরা নোটিশ দিয়ে এসেছি। এতে বলা হয়েছে- নোটিশ প্রাপ্তির সাথে সাথেই যেন অস্ত্রগুলো থানায় জমা দেওয়া হয়। অন্যথায় অবৈধ অস্ত্র হেফাজতে রাখার দায়ে তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের উত্থানের সময় চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার মোড়ে দিদারুল আলমের অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করার একটি ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে আলোচনায় আসেন তিনি। লাইসেন্স বাতিল হওয়া দু’টি অস্ত্রের মধ্যে একটি ওই অস্ত্র বলে জানিয়েছেন মাসুম।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে সারা নগরীতে যে তাণ্ডব চলছিল, সেটা ঠেকাতে আমি আমার লাইসেন্স করা অস্ত্রটি ব্যবহার করেছিলাম। তখন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাই বলেছিলেন- আমার সাহসী ভূমিকার কারণে চট্টগ্রাম রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু সেই অস্ত্রটিরও লাইসেন্সও বাতিল করা হলো।’
২০১৩ সালের পর একাধিক পাহাড়-বস্তি অধ্যুষিত ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর লালখান বাজার ক্রমাগতভাবে সন্ত্রাসের জনপদ হয়ে ওঠে। নিয়মিত হামলা-পাল্টা হামলা, সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ডসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় এমন অধিকাংশ ঘটনায় উঠে আসে দিদারুল আলম মাসুম ও তার অনুসারীদের নাম। ২০১৬ সালে নগরীর দক্ষিণ নালাপাড়ায় নিজ বাসার সামনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুন করা হয় নগর ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাসকে। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া এক আসামির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে- ফেসবুকে মাসুমের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে তার নির্দেশে লালখান বাজার থেকে সন্ত্রাসীরা গিয়ে সুদীপ্তকে খুন করেছে।
মাসুমের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনকারী কাউন্সিলর মানিক একসময় তার সঙ্গে থাকলেও সম্প্রতি তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি মাসুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন লালখান বাজারের বাসিন্দা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবুল হাসনাত বেলালও। মূলত মানিক ও বেলালের সঙ্গে দূরত্বের কারণে লালখান বাজারে মাসুমের একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব হতে শুরু করে বলে মনে করেন স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা। মাসুমের অনুসারী ও তার বিরোধী পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। এছাড়া মাসুমের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণেরও অভিযোগ আছে।
তবে দিদারুল আলম মাসুম মনে করেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে কাউন্সিলর মানিক তার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ করে তার অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করতে ভূমিকা রেখেছে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে দীর্ঘদিন ধরে হত্যার চেষ্টা করা হচ্ছে। অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে আমাকে নিরস্ত্র করা সেই চক্রান্তে অংশ। কাউন্সিলর মানিক সাহেব ব্যক্তিগতভাবে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই কাজ করেছেন। আমার কাছে যে পিস্তল আছে সেটি আমার পরিবারের সদস্যরাও জানেন না। আমার সন্তান বড় হয়েছে। অস্ত্রগুলো কখনো আমি সামনে আনি না। সেগুলো আমি ব্যবহার করি না। তারপরও মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে নিরস্ত্র করা হলো।’
কাউন্সিলর এ এফ কবির আহমেদ মানিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাসুমের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অনেকে অভিযোগ করেছেন। আমি তার মধ্যে একজন। মন্ত্রণালয় আমার কথা বিশ্বাস করেছে এবং তার অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করেছে।’
মাসুমকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে মানিক বলেন, ‘মাসুমকে কে হত্যা করবে? আমি ১৪ বছর ধরে কাউন্সিলর। ৯ বছর মাসুম এলাকায় ছিল না, গত চার বছর ধরে সে এলাকায় আছে। এরপর থেকে প্রতিবছর এলাকায় খুনখারাবি হয়েছে এবং সবগুলোতে সে অথবা তার লোকজন জড়িত থাকার কথা সাংবাদিকরাই পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। তাহলে খুনের রাজনীতি করে কে? আর মাসুমকে যদি কেউ হত্যা করতে চায়, তাহলে তার লাইসেন্সধারী অস্ত্র দু’টি কি তাকে বাঁচাতে পারবে? আমার বয়স এখন ৬৩ বছর। এই বয়সে আমি খুন-খারাবিতে জড়াব কেন?’