Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘২১ আগস্ট হাঁটার শক্তি কেড়ে নিয়েছে, তবু রাজনীতি ছাড়িনি’


২১ আগস্ট ২০১৯ ০১:১৩

ঢাকা: দেড় দশক আগের এই দিনটিতে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন না‌সিমা ফের‌দৌস। ম‌হিলা আওয়ামী লী‌গের কেন্দ্রীয় ক‌মি‌টির এই সহসভাপ‌তির শরীরে বিদ্ধ হয়েছিল হাজার স্প্লিন্টার। এক পা প্রায় হারিয়ে ফেলতেই বসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই পা কেটে ফেলতে হয়নি। তবে চলৎশক্তি হারিয়েছিলেন। এরপর দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও এখনো পূর্ণ চলৎশক্তি ফিরে পাননি তিনি। তবু ছাড়েননি রাজনীতির মাঠ। হুইল চেয়ারে করে যোগ দিয়েছেন দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে। এই নিবেদনের কারণে দলের পক্ষ থেকে স্বীকৃতিও পেয়েছেন। দশম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন থেকে সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

নাসিমা ফেরদৌস বলেন, ওই দিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কোনোভাবেই ভুলতে পারি না। মনে হচ্ছিল, জীবনটাই আর ফিরে পাব না। আল্লাহর রহমতে জীবনটা ফিরে পেয়েছি, তবে স্বাভাবিক হতে পারনি এখনো। তবু রাজনীতিটা ছাড়িনি।

আরও পড়ুন- ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: বর্বরোচিত নৃশংসতার দেড় দশক

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ছিল সেই কালো দিন। সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা। লক্ষ্য ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ওই সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। দলীয় নেতাকর্মীদের তৈরি মানবঢালে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও সেদিন প্রাণ হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী। আহত হন তিন শতাধিক মানুষ।

দেড় দশক পরও সেই ভয়াবহ দিনটির কথা মনে হলেই শিউরে ওঠেন নাসিমা ফেরদৌস। মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) তার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। আলাপে তিনি তুলে ধরেন সেদিনের ভয়াল ঘটনাপ্রবাহ।

নাসিমা বলেন, ওই সময় আমরা ছিলাম বিরোধী দল। সারাদেশে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সিলেটে আমাদের একটি অনুষ্ঠানে বোমা হামলাও হয়েছিল। এর প্রতিবাদে ২১ আগস্ট একটি প্রতিবাদ র‌্যালি আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) এই র‌্যালি উদ্বোধন করার কথা ছিল। আমি তখন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দায়িত্বে ছিলাম। বিকেল ৩টার দিকে সংগঠনের মিছিল নিয়ে উপস্থিত হই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে। শুরু হয় অনুষ্ঠান, নেত্রীও তখন বক্তব্য দিয়ে ফেলেছেন।

নাসিমা বলেন, নেত্রীর বক্তব্য শেষে সাংবাদিকরা সবাইকে দাঁড়াতে বলেন ছবি নেওয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে বিকট শব্দে যেন কানে তালা লেগে যায়। হঠাৎ দেখি আগুনের ধোঁয়া। কী হলো— বুঝে উঠতে না উঠতেই মাটিতে পড়ে যাই। আইভী আপা (প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমান) মা বলে চিৎকার দিলেন। তাকে ধরতে চাইলাম, কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। শুধু তাকিয়ে দেখছি। দেখলাম, নেত্রীকে দলের নেতারা ঘিরে ধরে ঢেকে রেখেছেন।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- শ্রবণশক্তির স্থায়ী ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন শেখ হাসিনা

ঠিক চোখের সামনে যেন সেদিনের সেই ভয়াবহতা দেখতে পাচ্ছেন নাসিমা। তিনি বলতে থাকেন, আবার একটি শব্দ। পরে জানতে পেরেছি, আরেকটি গ্রেনেড তখন নিক্ষেপ করা হয়। মনে হচ্ছে, পা দুইটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। পেটের ভেতরেও ‌কী যেন ঢু‌কে‌ছে। নিজেকে সরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। তাকিয়ে দেখি, পায়ের জায়গায় শুধু রক্ত আর রক্ত। আশপাশে তাকাই, চারপাশে সবখানে পড়ে রয়েছে মানুষের রক্তাক্ত নিথর সব দেহ। দেখতে দেখতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

জ্ঞান ফেরার পর নাসিমা নিজেকে দেখতে পান একটি ট্রাকে, সেখানে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি লাশ। চিৎকার দিয়ে উঠলে কেউ একজন এসে দেখতে পান তাকে। পরে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। তখনো জ্ঞান ছিল নাসিমার। দেখতে পান, রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে।

নাসিমা বলেন, ওই সময় একজন সাংবাদিক এসে পরিবারের কারও ফোন নম্বর চান। কিন্তু কারও ফোন নম্বর মনে করতে পারি না। অনেক চেষ্টার পর ছেলের ফোন নম্বর বলতে পারি তাকে। ওই সাংবাদিক তখন ছেলেকে ফোন দেন। বলেন, আপনার মা ঢাকা মেডিকেলের করিডোরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। আপনারা আসেন। তখন আমার ছেলে হাসপাতালে আসে।

নাসিমা জানান, হাসপাতালে আইভী রহমানের পা কেটে ফেলা হয় ওই সময়। নাসিমার পা-ও কেটে ফেলার কথা বলেন চিকিৎসকরা, তবে তাতে রাজি হননি তার পরিবারের সদস্যরা। পরে তাকে পাঠানো হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। কিন্তু পা কাটতে না দেওয়ায় সেখানে তাকে ভর্তি নেওয়া হয় না। ওই সময় রক্তও প্রয়োজন ছিল তার, সিএমএইচ থেকে অন্য কোনো হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন অ্যাম্বুলেন্স। আত্মীয়-স্বজনরা অনেক কষ্টে সেগুলোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু পা কাটতে রাজি না হওয়ায় কোনো হাসপাতালেই ভর্তি নেওয়া হয় না তাকে। সব হাসপাতালেই চিকিৎসকদের এক কথা, এ রোগীর পা কাটতে হবে, নইলে রোগী মারা যাবে।

নাসিমা বলেন, ওই সময় আমরা যোগাযোগ করি আমাদের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এফ এম রুহুল হকের সঙ্গে। তিনি উত্তরাতে চলে আসেন। তখন আমাকে রক্ত দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু অন্যদিক থেকে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল। পরে বাংলাদেশ মেডিকেলে আমার অপারেশন হয়। কিন্তু পা’তে তখন পচন ধরে গেছে। এভাবে কয়েকটা দিন গেলে নেত্রী জানতে পারেন আমার কথা। তখন তার উদ্যোগেই চার-পাঁচ দিন পর দিল্লি পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। সেখানে চিকিৎসা করে খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করি।

আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, সেদিনের ঘটনার ১৫ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণা আরও বাড়ছে। দীর্ঘদিন বিছানায় থাকতে হয়েছে। হাঁটতে শুরু করেছি অনেক পরে। আর এখনো তো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি না। আর কোনোদিন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারব কি না, তাও জানি না।

শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্যই ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল বলে মনে করেন নাসিমা। তিনি বলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি বেঁচে গেছেন। আর তিনি বেঁচে গেছিলেন বলেই ওইদিন যারা আমরা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলাম, তারা চিকিৎসা পেয়েছি। তিনি না বেঁচে থাকলে হয়তো আমি নিজেও আর কোনোদিন পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারতাম না।

তারুণ্যেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন নাসিমা ফেরদৌস। ২১ আগস্ট হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার পর দীর্ঘদিন বিছানাতেই থাকতে হয়েছে তাকে। তারপরও রাজনীতি ছাড়েননি। তিনি বলেন, আমার সুস্থ জীবন ছিল। দেশের জন্য, মানুষের জন্য রাজনীতি করতাম। ওই দিনের পর শুরুর দিকে ভাবতেই পারিনি আর কখনো রাজনীতিতে ফিরতে পারব। কিন্তু আল্লাহ যখন প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন, পুরোপুরি না হলেও কিছুটা সুস্থ করে দিয়েছেন, তখন আর পিছু ফিরে তাকাইনি। মানুষের জন্য যতটা করতে চেয়েছিলাম, ততটা করতে পারিনি। কিন্তু তবু হাল ছাড়িনি। হুইল চেয়ারে বসেও মিটিং-মিছিলে যোগ দিয়েছি, সব আন্দোলনে রাজপথে থেকেছি। সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করেছি। এখনো বলছি, যতদিন জীবন আছে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হয়ে মানুষের জন্য কাজ করে যাব।

রাজনীতিতে নিবেদিত ছিলেন বলেই গত সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন নাসিমা ফেরদৌস। তিনি মনে করেন, দলের এই মূল্যায়নটুকু জরুরি। নাসিমা বলেন, আমি ভোগের নয়, ত্যাগের রাজনীতি করি। দল যতটা মূল্যায়ন করেছে, তাতে অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণ নেই। কারণ আমাদের মতো নেতাকর্মীদের যদি মূল্যায়ন করা না হয়, তাহলে তো ত্যাগী নেতা জন্মাবে না। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হলেই অন্যরাও এগিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদীরা যেন কোনোভাবে সুযোগ না পায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

হামলার দীর্ঘ ১৪ বছর পর গত বছরের অক্টোবরে গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারিক আদালত। তবে এরপর আর এগোয়নি মামলা। আপিলের জন্য পেপারবুকও তৈরি হয়নি বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণার ১০ মাস পরও। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে খানিকটা অসন্তোষ আছে নাসিমার। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, শেখ হাসিনাই পারবেন এই ঘৃণ্য হামলার অপরাধীদের শাস্তি কার্যকর করতে।

নাসিমা বলেন, দীর্ঘদিন পরে হলেও এই মামলার রায় হয়েছে। পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হতে পারলেও কিছুটা স্বস্তি তো আছেই এই রায়ে। এখন চাওয়া, আপিল নিষ্পত্তি হয়ে দ্রুত এই মামলায় দোষীদের শাস্তি কার্যকর হোক। নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলেই কেবল এটি সম্ভব। উনি যেভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের সাজা কার্যকর করেছেন, একইভাবে এই হামলার দোষীদের সাজাও কার্যকর করবেন বলেই বিশ্বাস করি।

সবশেষে নাসিমার চাওয়া একটিই, এ ধরনের হামলার শিকার যেন আর কাউকে না হতে হয়। তিনি নিজে এবং তার দলের শত শত নেতাকর্মী ভুগছেন, কিন্তু তাদের মতো করে যেন আর কাউকে ভুগতে না হয়— সেটাই চান আওয়ামী লীগের এই নেতা।

২১ আগস্ট ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আওয়ামী লীগ গ্রেনেড হামলা নাসিমা ফেরদৌস বিচার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর