Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মনে হয়েছিল এটাই কেয়ামত!


২১ আগস্ট ২০১৯ ১৩:৪৪

ঢাকা: ‘হঠাৎ বিকট আওয়াজ! প্রচণ্ড ধাক্কা আর ঝাঁকুনি খেলাম। ভাবলাম যে ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে সেই ট্রাকের চাকা বার্স্ট হয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি সেটা একটা গ্রেনেড। পরে বিকট শব্দে আরও একটি আওয়াজ হলো। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে একটি ফুঁলকি দেখতে পেলাম। তারপর দেখতে পাই আরেকটা গ্রেনেড অবিস্ফোরিত হয়ে ট্রাকের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।

https://www.youtube.com/watch?v=nYIesmKCNfo

নেত্রীকে দেখতে পাইনি। মানবঢাল তৈরি করে উনাকে ঘিরে রাখা হয়েছিল। একটা প্রচণ্ড রকম ঝড় ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় ধানগুলো যেভাবে শুয়ে পড়ে মানুষগুলোও ঠিক সেভাবে শুয়ে পড়ে। সবাই রক্তাক্ত, চারদিকে চিৎকার। ছুটছে দিগ্বিদিক।

আমি এগিয়ে যেতে যেতে সব শক্তি হারালাম। পরে কর্মীরা আমাকে চিনে নিরাপদ স্থানে নিতে চাইলো। পুলিশের ভ্যানে তুলতে চাইলো। তারা আমাকে গ্রহণ করেনি। এর জেরে কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ঝগড়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। আমাকে রেখে কর্মীরা তখন নিরাপদ স্থানে যায়। তখন ভাবলাম আমি মরেই যাচ্ছি, বাঁচবো না। কেউ আমাকে আর রক্ষাও করতে পারবে না। ধোঁয়া ও গ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধে নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। তখন ভাবছিলাম, যে কেয়ামতের কথা শুনি, কেয়ামত কেমন হবে, কী হবে, আমরা জানি না। তবে আমার কাছে সেই সময় মনে হয়েছিল এটাই হয়তো কেয়ামত!’—কথাগুলো বলছিলেন ২১ আগস্টের ভয়াল গ্রেনেড হামলায় আক্রান্ত আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান। সেসময় তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

আরও পড়ুন- ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: বর্বরোচিত নৃশংসতার দেড় দশক

অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরির দায়িত্ব ছিল মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের অস্থায়ী মঞ্চে বেলা দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে পৌঁছান বজলুর রহমান। মাইক পরীক্ষা করেন। মঞ্চ ঠিকঠাক আছে কি না তাও দেখে নেন। সোয়া দুইটার মধ্যে মিছিল আসা শুরু করে। আড়াইটার মধ্যে সভাস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন

প্রথমে বক্তৃতা করেন মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা পরে কেন্দ্রীয় নেতারা। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা বিকাল ৫টায় সভাস্থলে পৌঁছে প্রায় কুড়ি মিনিটের মতো বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতা শেষে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা মঞ্চ থেকে নামার মুহূর্তে দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১১টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। এতে আইভি রহমানসহ মারা যান ২৪ জন। ওই ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক নেতা-কর্মী। বজলুর রহমান তাদেরই একজন। এক যুগের বেশি সময়ের আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি সারাবাংলার কাছে আরও একবার তুলে ধরলেন।

বজলুর রহমান বলেন, ‘আমি আইভি আপার পাশে দাঁড়ালাম। নেত্রী জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে বক্তৃতা শেষ করলেন। ঠিক তখনই ফটোসাংবাদিক গোর্কি, সে এসে বললো নেত্রী আমি তো ছবি নিতে পারিনি। নেত্রী একটু হোল্ড করলেন। ঠিক তখনই একটি বিকট আওয়াজ। সেই আওয়াজটার সময় আমি সাংঘাতিকভাবে একটি ধাক্কা খেলাম। মনে হল কেউ আমাকে প্রচণ্ড রকমের একটা ঝাঁকুনি দিল। ভাবলাম যে অস্থায়ী মঞ্চ করেছি ট্রাকের মধ্যে, সেই ট্রাকের চাকাটি বার্স্ট হয়েছে।’

আরও পড়ুন- ১৫ বছরে শেষ হয়নি বিচার, ৯ মাসেও তৈরি হয়নি পেপারবুক

সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন ভাবলাম আমরা সাংঘাতিক সংকটের মধ্যে পড়েছি। হয়তো আমাকে একটি নিরাপদ জায়গার দিকে যেতে হবে। আমি পশ্চিম দিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেই দিকে গেলে হয়তো সেইফ হতো পারবো। যখন আমি যেতে চাইলাম তখন আর যেতে পারলাম না। কারণ তখন আমি আর হাঁটতে পারি না। বিরাট বড়ো ধাক্কা লেগেছে সেটা আমি বুঝতে পারিনি যে এত বড় ধাক্কা। তখন আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না, পড়ে গেলাম। পরে দুই কুনুই দিয়ে ক্রলিং করে কিছুটা এগিয়ে সেইফ সাইডে যেতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না, শরীর অসার হয়ে আসছিল। দেখলাম সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে আছে। তাকিয়ে দেখলাম অনেক মানুষ একেবারে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একটু পরেই চিৎকার চেঁচামেচি শুনলাম। কেউ কেউ বলছে বজলু ভাই, বজলু ভাই। যেসব কর্মীরা চিনেন তারাও বজলু ভাই বলে চিৎকার করছে। তারা আমাকে তুললো। তখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো। আমাকে পুলিশের ভ্যানে তুলতে চাইলে পুলিশ আমাকে নিল না। এই কারণে কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে। একটা পর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্চ এবং টিয়ার গ্যাস ছোঢ়। তখন কর্মীরা আমাকে রেখে নিরাপদে চলে যায়।’

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- শ্রবণশক্তির স্থায়ী ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন শেখ হাসিনা

পরে আবার জ্ঞান ফিরলে দেখতে পাই বেশকিছু কর্মী আমাকে এটিএন বাংলার গাড়িতে তুললো। তারা আমাকে জিরো পয়েন্ট হয়ে হাইকোর্ট মাজার দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসলো। হাইকোর্ট পর্যন্ত আমার খেয়াল আছে। এরপরে আর খেয়াল নেই। যখন ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হল তখন সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই। ড্যাব নেতাদের নির্দেশে সাংঘাতিকভাবে তারা অসহযোগিতা করছিল। কর্মীরা আমরা প্যান্ট কেটে বেডশিট দিয়ে বেঁধে রেখেছে। সেটাও রক্তে লাল হয়ে গেছে। সেখানে চিকিৎসা হবে না জেনে স্কুটারে করে প্রথমে মডার্ন হাসপাতাল ও পরে শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানেও রোগী ধারণের ঠাঁই নেই। আমাকে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে আসলো। এখানে আমার একটু জায়গা হল। সেখানে আমার অবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছিল। স্প্রিন্টার আমার নিচের অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। একটা সময় আমাকে সিসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। একটা অপারেশন খুব দরকার হয়ে পড়ে। যে অপারেশনটি করার মতো অভিজ্ঞতা আমাদের এখানেই নেই। স্ত্রীর কাছ থেকে বন্ড সই নিয়ে মাঝরাতে সেই অপারেশনটি হল। সে কারণে আল্লাহপাক হয়তো আমাকে সেইফ করেছেন। আমি বেঁচে গিয়েছি। দীর্ঘ এক মাস আট দিন সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলাম। সেখানে অনেক মহিলা কর্মীও চিকিৎসাধীন ছিল। তাদের চিৎকার শুনেছি সারারাত। তারা চিৎকার চেচামেচি করেছে। সেসময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অর্থ সংগ্রহ করে আমাদের সবার চিকিৎসা করেন। দেখভাল করেছেন। লোক মারফত অসুস্থ নেত্রী আমাদের খোঁজখবর সব সময় রাখছিলেন। একটা পর্যায়ে দেখলে এবং জানলেন আমার চিকিৎসাটা এখানে হবে না সেভাবে। কারণ আমার কিডনিতে স্প্লিন্টার ঢুকেছে। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেও। আমাকে বিদেশ পাঠানো হবে কিন্তু পাসপোর্ট ছিল না। নেত্রী আমাকে পাসপোর্ট করে দিলেন। দুইটা পাসপোর্ট, আমি ও আমার ওয়াইফ। তখনো আমার পাসপোর্টটি এসবি দিতে গড়িমসি করছিল। পাসপোর্টটি আটকিয়ে দিলো। তখন একটি পত্রিকায় সেই খবর প্রকাশিত হল। তারপরে অবশ্য পাসপোর্টটি দেওয়া হয়। পরে বাংলাদেশ মেডিকেল থেকে আমাকে কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার শরীরে ৫৮টি স্প্লিন্টার রয়েছে। নয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি কিডনিতে। কিছু শিরার মধ্যে আছে। আমার একটাই কিডনি। ফলে সেখানে অপারেশন বাতিল হল। আমাকে এসব স্পিন্টার এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন- ‘২১ আগস্ট হাঁটার শক্তি কেড়ে নিয়েছে, তবু রাজনীতি ছাড়িনি’

অমাবশ্যার রাতে স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা এখনো অসহ্যের হয়ে ওঠে জানিয়ে বজলুর রহমান বলেন, ‘আমার সন্তানদের পৃথিবীতে রেখে যাবো। সবাইকে যেতে হবে, আমিও যাবো। ওদেরকে আমি রেখে যাবো। আমার এই সহায় সম্পত্তি বাড়িঘড় সবই রেখে যাবো। কিন্তু যে স্পিন্টারগুলো আমার গায়ে আছে আমি এদেরকে পৃথিবীতে রেখে যেতে পারবো না। এদেরকে আমার নিয়েই যেতে হবে। পরপারে এরাই আমার সঙ্গী হবে। এরাই আমার সঙ্গে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি অন্য আরও অনেকের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি না। যেমন অনেকেই অনেকক্ষণ ঘুমায়। অনেক রেস্ট নেন। এটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ আমার একটা শিরার মধ্যেই তিনটি স্পিন্টার রয়েছে। হাঁটাচলা করলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। যখন রেস্ট নিই, ঘুমাই ওই তিনটা একসঙ্গে জমাট বেঁধে যায়। তখন আমি আর ঘুমাতে বা রেস্ট নিতে পারি না। এজন্য বেশি বেশি হাঁটতে হয়, চলাচল করতে হয়। কিডনিতে যেটা আছে সেটা আর বের করা সম্ভব না। তারপরেও মনে হয় এখন যে জীবনে আছি এটা তো বোনাস লাইফ।’

আরও পড়ুন- বিএনপির দৃষ্টিতে ২১ আগস্ট

ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলার রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়ে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার বিচারটি দীর্ঘ সময় ধরে হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে প্রচলিত আইনেই হয়েছে। তারা আপিল করেছেন। বিচার যাতে সঠিক করা যায়। আমরা চাই দ্রুত রায়টি কার্যকর হোক। কিন্তু বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার প্রশ্ন যাদের নাম এই মামলাতে আছে, যারা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে আছে, সেইসব দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে আছেন, তারা কিভাবে তাদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে? তাদের এই দেশের আইনের আওতায় যদি হস্তান্তর না করা হয়, তাহলে তারা কিভাবে মানবাধিকারের বুলি আওড়ায়?’

২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর