রিশা হত্যার ৩ বছর: বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় বাবা-মা
২৮ আগস্ট ২০১৯ ০০:০১
ঢাকা: রাজধানীর কাকরাইলে এলাকায় তিন বছর আগে ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছিলো উইলস লিটল ফ্লাইওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার রিশা। রিশা হত্যা মামলাটির তিন বছরেও শেষ হয়নি বিচার।
২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট দুপুর পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা (১৫) ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়। তাকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ আগস্ট মৃত্যু হয় রিশার।
রিশা হত্যাকাণ্ডে তার মা তানিয়ে হোসনে বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের বৈশাখী টেইলার্সে একটি পোশাক বানাতে দেয় রিশা। ওই টেইলার্সের রশিদে বাসার ঠিকানা ও রিশার মায়ের মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল। সেই রশিদ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে টেইলার্সের কাটিং মাস্টার ওবায়দুল খান (২৯) রিশাকে ফোনে উত্ত্যক্ত করত। পরে ফোন নম্বরটি বন্ধ করে দিলে ওবায়দুল স্কুলে যাওয়ার পথে রিশাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় রিশাকে ছুরিকাঘাত করা হয়।
মেয়ে খুন হওয়ায় তিন বছর পাড়ি দেওয়ার পরে আজও রিশার বাবা-মা কানে ভেসে আসেন তার মেয়ের কণ্ঠের স্বর। রিশা যেন তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় তার ছোট ভাই বোন নিয়ে খেলা করছে। চারিদিকে সেই স্মৃতি আজও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে রিশার বাবা-মাকে।
সুরাইয়া আক্তার রিশা বাবা রমজান হোসেন বলেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়ে মারা যাওয়া আজ তিনবছর হয়েছে। আমার মেয়ে আর আমাকে বাবা বলে ডাকে না। প্রতিদিন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে রিশা বাবা বাবা করে কাছে আসত। মাঝে মধ্যে আামকে জড়িয়ে ধরে আদর করত। বাড়িতে যখনিও থাকতো তার ছোট ভাই-বোনকে সে সব সময় আদর করতো। বাড়ির ছোটখাটো কোনো কাজ ফেলে রাখত না। তার মায়ের সব কাজে সাহায্য করত। মাঝে মধ্যে এখনো মনে হয় আমার বাবা বলে ডাকছে। তখনও বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। পাষণ্ড আমার মেয়েকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমি আমার মেয়ের হত্যাকারীর ফাঁসি চাই। আর যেন কোনো বাবাকে তার মেয়ে হারাতে না হয়।’
এ মামলার বাদী ও রিশার মা তানিয়া হোসেন বলেন, ‘আমার মেয়ের মৃত্যু হওয়া তিন বছর হয়ে গেল। দীর্ঘ তিন বছর ধরে বিচার হবে বলে আশায় বুক বেঁধে আছি। আসামি ওবায়দুল আমার মেয়েটাকে বাঁচতে দিল না। ভেবেছিলাম চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আমার মেয়ে বাসায় ফিরবে। কিন্তু আর ফিরল না। মেয়ে হত্যার বিচার পাব এ আশায় তিন বছর ধরে আদালতে বারান্দায় ঘুরতেছি। আমার আর্তনাদ আমার কানে আজও ভেসে আসে। প্রতি ধার্য তারিখে সকাল ৯টার মধ্যে আদালতে চলে যাই। আর বাসায় আসতে ৫ টায় বেজে যায়। শুধু বিচারের আশায় ঘুরতেছি। আর কিছু চাই না। একটাই দাবি, আমি আসামির ফাঁসি চাই।’
রিশার মৃত্যুর পর তার হত্যাকারীর বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে স্কুলের সহপাঠীরা। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশ্বাস দেন, আসামি ওবায়দুলকে দ্রুত আটক করে বিচারের আওতায় আনা হবে। পরে ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর নীলফামারীর ডোমার এলাকা থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ ওবায়দুলকে গ্রেফতার করে। ওবায়দুল আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কেএম ইমরুল কায়েশের আদালতে বিচারাধীন। মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট মামলাটিতে ওবায়দুল হক নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আত্মপক্ষ শুনানি করেন। আগামী ১১ সেপ্টেম্বর মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ধার্য রয়েছে।
২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর মামলাটি তদন্ত করে ওবায়দুল হককে একমাত্র আসামি করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার পুলিশ পরিদর্শক আলী হোসেন। এরপর বছরের সালের ১৭ এপ্রিল মামলার একমাত্র আসামি ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। মামলাটিতে ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছেন আদালত ।
মামলাটির সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল জানান, মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আসামির আত্মপক্ষ শুনানি শেষ হয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে রয়েছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে মামলাটির বিচার শেষ হওয়ার আশা করছি।
তিনি আরও বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে একটা মেয়েকে ছুরি মেরে হত্যা করেছে। তার এমন সাজা হওয়া উচিত যেন ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে সাহস না পায়। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি।
বাদীপক্ষে আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার রিংকি জানান, আশা করেছিলাম ১ বছরের মধ্যেই এ মামলার বিচার কাজ শেষ হবে। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। একারণে মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। এখন আর আইনি জটিলতা নেই অচিরেই মামলার বিচার পাবো বলে আশা করছি। মামলাটির বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আমরা আসামির ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট আশা করছি। আর যেন এধরনের ঘটনা না ঘটে।
অপরদিকে আসামির পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট রিশার মা তানিয়া রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় এবং পেনাল কোডের ৩২৪/৩২৬/৩০৭ ধারায় হত্যাচেষ্টা ও গুরুতর আঘাতের অভিযোগে একটি মামলা করেন। রিশার মৃত্যুর পর হত্যার অভিযোগে ৩০২ ধারায় রূপান্তরিত করা হয়।