ওমানের মাসকট ব্যাংক হয়ে জার্মানি যেত ঢাকার ক্যাসিনোর টাকা
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৪:১২
ঢাকা: দেশে চাঁদাবাজি- টেন্ডারবাজির টাকা ছাড়াও ক্যাসিনোর টাকার ভাগ যেত জার্মানিতে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের কাছে। সে টাকা পাঠানো হতো ওমানের মাসকট ব্যাংকের মাধ্যমে। ওমানে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাদিম সেখান থেকে টাকা তুলে জার্মানিতে থাকা জিসানের কাছে পৌঁছিয়ে দিত। ঢাকা থেকে এই আয়োজন করে দিতেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীম গং। সবসময় একই রুট অনুসরণ করা হতো না। কখনো কখনো সিঙ্গাপুর হয়েও টাকা যেত জিসানের কাছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জি কে বিল্ডার্স নামের একটি কোম্পানি বর্তমানে শামীমের নামে থাকলেও তা একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ছিল। জিসান দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর কোম্পানিটির হাল ধরেন অপর সন্ত্রাসী নাদিম ওরফে টিএনটি নাদিম। এরপর নাদিমও দেশ ছাড়া হলে তা জি কে শামীমের হাতে চলে আসে। এই জিসান, নাদিম ও শামীম তিনজনই বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় যুবদলের রাজনীতি করতেন।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু বড় বড় টেন্ডারে কাজ পেয়েছে জি কে বিল্ডার্স। আর সেখানে সহায়তা করছেন যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও সাংগাঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।
সূত্র জানায়, অন্য কেউ টেন্ডার জমা দিলেও সম্রাট ও খালেদের হস্তক্ষেপে তা বাতিল হয়ে যেত। কাজ যেত জি কে বিল্ডার্সের হাতে। এর থেকে আয় করা টাকার একটা মোটা অঙ্ক সম্রাট ও খালেদ পেতেন।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নির্ভরযোগ্য সূত্রটি আরও জানায়, এই জি কে বিল্ডার্সের একটি শাখা রয়েছে সিঙ্গাপুরে। যেখানে টিএনটি নাদিম বসেন। শামীম, সম্রাট, খালেদও মাঝে মধ্যে সেখানে যান। আর ওদিকে জার্মানি থেকে উড়ে আসেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানও। ওই অফিসে বসেই টেন্ডার বাগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাগুলো হয়।
তবে কেবল সিঙ্গাপুরই নয়, ওমানের রাজধানী মাসকটও এই সন্ত্রাসী চক্রের আরেকটি হাব বলেও জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে এসেছে বলে জানায় গোয়েন্দা সূত্র। সূত্রমতে, সন্ত্রাসী টিএনটি নাদিম মাঝে মধ্যে ওমান ও দুবাইতে গিয়েও থাকেন। সেখান থেকে ঢাকায় তার লোকজন দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। জিসান ও নাদিমের হয়ে যারা কাজ করছেন মগবাজার টিএনটি কলোনির জাকির, নয়াটোলার সেন্টু ও শোভন, বাড্ডার নাসির ও খোকন। এখনও তারা জিসান ও নাদিমের হয়ে চাঁদাবাজি করছেন বলেও গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
আর টেন্ডারবাজিতে সম্রাট, খালেদের সহায়তায় কাজ না হলে, সন্ত্রাসী এই চক্রটিকে কাজে লাগিয়ে হত্যা, অপহরণের হুমকি দিয়ে টেন্ডার বাগিয়ে নেওয়া হতো। অধিকাংশ সময়ে সহায়তায় কাজ হতো। ফলে টেন্ডার বাগানোর পর নাদিম ও জিসান সিঙ্গাপুরে চলে যেত আর শামীম, সম্রাট ও খালেদ উড়াল দিতেন ঢাকা থেকে। সেখানে চলতো তাদের নানারকম মৌজ-মাস্তি, জানায় গোয়েন্দা সূত্রটি।
এই টেন্ডার ও ক্যাসিনোর টাকার ভাগ সিঙ্গাপুর থেকে ওমানের মাসকট ব্যাংকে পাঠানো হতো। আর সেখান থেকে টাকা যেত জামার্নিতে।
ওমানের মাসকট ব্যাংকে যে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হতো সেই অ্যাকাউন্টের নম্বর গোয়েন্দাদের কাছে রয়েছে এমনটা জানিয়ে সূত্রটি ৪৮৩৭৯১৩১৯৪৭৯৭৯৭৮ নম্বরটিকে ওই অ্যাকাউন্ট নম্বর বলে এই প্রতিবেদককে জানায়। সূত্র জানায়, এই টাকা সরাসরি কখনো সম্রাট আবার কখনো খালেদ নিজেই পাঠাতেন। আবার মাঝে মধ্যে জাকির ও আরমানের মাধ্যমে টাকা মাসকট ব্যাংকে পাঠানো হতো।
সূত্র আরও জানায়, কিছু দিন হলো শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে যুবলীগের খালেদের দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ায় জিসান নাদিমকে দায়িত্ব দেয় খালেদকে শায়েস্তা করার জন্য। নাদিম ও জিসান দুবাইয়ের বুরুজ খলিফা টাওয়ারে বসে খালেদ, সম্রাট ও শামীমকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে। এ জন্য একে-২২ অস্ত্রও কেনা হয়। আর এ দায়িত্ব দেওয়া হয় মগবাজারের শোভনকে। তবে গোয়েন্দারা ওই অস্ত্রটি উদ্ধার করলে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
গোয়েন্দারা জানান, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ নানা ধরনের তথ্য দিতে শুরু করেছেন। যা যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। খালেদের কাছ থেকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব তথ্য যেন পাওয়া যায় সে ব্যাপারে সতর্ক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলে জানায় সূত্রটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জিজ্ঞাসাবাদ সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক রকম ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেইসব তথ্যও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহজাহান সাজু সারাবাংলাকে বলেন, ‘খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদে নানা ধরনের তথ্য এসেছে। তবে মানি লন্ডারিং বিষয়ে এখনও আমরা কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করিনি। এটি সিআইডির সংশ্লিষ্ট শাখা জিজ্ঞাসাবাদ করবে।’
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) শারমিন জাহান বলেন, ‘খালেদের বিরুদ্ধে গুলশান ও মতিঝিল থানায় দুটি মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। সেগুলোর কাগজপত্র আমরা এখনও হাতে পাইনি। কাগজপত্র হাতে এলে তা পর্যালোচনা শেষে আমরা তদন্ত শুরু করব। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে কোন দেশের কোন ব্যাংকে টাকা গেছে সেটিও তদন্ত করে বের করা হবে।’
এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিলের ইয়ং মেনস ক্লাব ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অন্যদিকে র্যাব-১ গুলশান-২ এ খালেদের বাসায় অভিযান চালায়। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ওই বাসা থেকে অস্ত্র, গুলি, নগদ টাকা ও মাদকসহ খালেদকে আটক করে র্যাব। পরদিন তাকে গুলশান থানায় দেওয়া হয়। ওই থানায় অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে তিনটি আলাদা মামলা দিয়ে ১৪ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে তোলে পুলিশ। আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। খালেদ এখন রিমান্ডে ডিবির হেফাজতে রয়েছেন।
অন্যদিকে গত ২০ সেপ্টেম্বর র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায় আরেক মাফিয়া ডন সম্রাট-খালেদের ডানহাত খ্যাত জি কে শামীমের নিকেতনের অফিসে। সেখান থেকে নগদ ১০ কোটি টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিয়ারসহ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করে। একইসঙ্গে কলাবাগান ক্লাবেও অভিযান চালায় র্যাব-২। সেখান থেকে কৃষক লীগ নেতা ও কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি সফিকুল আলম ফিরোজকে অস্ত্র ও মাদকসহ আটক করা হয়।
আরও পড়ুন
বিএনপিই ঢাকাকে ক্যাসিনোর শহর বানিয়েছিল: কাদের
খালেদের ক্যাসিনোতে প্রতি রাতে লেনদেন হতো কোটি টাকা!
ক্যাসিনো থেকে প্রতি রাতে ৪০ লাখ ‘আয়’ সম্রাটের
ঢাকায় কোনো ক্যাসিনো থাকবে না: ডিএমপি কমিশনার
ক্যাসিনোতে প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
পুলিশ, নেতা, সাংবাদিক, সন্ত্রাসী— সবার পকেটে ক্যাসিনোর টাকার ভাগ
ক্যাসিনো খালেদ জি কে শামীম জিসান মাসকট ব্যাংক শীর্ষ সন্ত্রাসী সম্রাট