‘খালেদা জিয়ার কাছে প্যারোলে মুক্তির চেয়ে কারাগারে মৃত্যু শ্রেয়’
১৬ অক্টোবর ২০১৯ ২২:০৮
ঢাকা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় মন্তব্য করেছিলেন, খালেদা জিয়ার জন্য প্যারোলে মুক্তির চেয়ে কারাগারে মৃত্যুই শ্রেয়। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এমন মন্তব্যে সায় দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া নিজেই। তিনি বলেছিলেন, ‘গয়েশ্বর ঠিক বলেছে।’
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নিজেই সারাবাংলাকে এভাবেই কথাগুলো বলেছেন। প্যারোল নিয়ে গত এপ্রিল মাসে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কী আলাপ হয়েছিল?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয় সংসদ সদস্যর শপথ ও ম্যাডামের প্যারোলে মুক্তি নিয়ে ওই সময় পত্র-পত্রিকায় খুব লেখালেখি হচ্ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্যারোলের বিষয়টি খালেদা জিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু তিনি প্যারোলে মুক্তির চেয়ে কারাগারে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করেন।’
কেবল গয়েশ্বর নন, বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন— বিএনপির এমন কয়েকজন শীর্ষ নেতা ও কয়েকজন দলীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেও খালেদা জিয়ার এমন মনোভাবের কথা জানা গেছে। তারা বলছেন, এমন মনোভাব থেকেই এ বছরের মধ্য এপ্রিল থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা, পরিবারের সদস্য ও দলীয় এমপিদের মাধ্যমে পাঠানো সমঝোতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু বরণ করবেন, তবুও প্যারোলে মুক্তি নেবেন না।
আরও পড়ুন- খালেদা জিয়ার মুক্তি কোন পথে? জানে না বিএনপি
খালেদা জিয়ার কারাবন্দির ১৪ মাস পর গত বছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ১৫ এপ্রিল তার সঙ্গে দেখা করতে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায়।
দলীয় সূত্রমতে, এই তিন জনের মধ্যে প্রথম দু’জন খালেদা জিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, দল ও দেশের জন্য তাকে বাঁচতে হবে। বাঁচতে হলে তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। আর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন মুক্তি। কিন্তু আদালতের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করা সম্ভব না। জামিনের ক্ষেত্রে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা বারবার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্যারোলে মুক্তিই একমাত্র পথ। খালেদা জিয়া যদি রাজি থাকেন, তাহলে বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন তারা।
ওই দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়া তৃতীয় জন, অর্থাৎ গয়েশ্বরচন্দ্র রায় প্রথম দু’জনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। খালেদা জিয়ার ঠিক সামনে বসা তৃতীয় জনের মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, সমঝোতার মাধ্যমে ম্যাডামের মুক্তির চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। তাছাড়া প্যারোল গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে তারা বিরুদ্ধে আনীত সব অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া এবং তাকে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেটা মেনে নেওয়া।’
তৃতীয় জনের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মরবেন, তবুও সমঝোতা বা প্যারোলে মুক্তি নেবেন না। তাছাড়া তিনি কোনো অপরাধ করেননি। যে টাকার জন্য তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সে টাকা তিনি ছুঁয়েও দেখেননি। রাজনৈতিক কারণে তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি জামিন পাওয়ার যোগ্য। জামিনেই তিনি মুক্ত হতে চান, প্যারোলে নন।
বিএসএমএমইউতে থেকে বেরিয়ে এসে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ মাধ্যমে বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্যারোল নেবেন না।’
দলীয় সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার এমন অনড় অবস্থানের পরও তার শারীরিক অবস্থা এবং দলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিএনপির একটি অংশ গত গত ছয় মাসে বেশ কয়েকবার দলীয় প্রতিনিধি, পরিবার ও দলীয় এমপিদের দিয়ে প্যারোলের বিষয়টি খালেদা জিয়ার কাছে তুলে ধরেছেন। আর খালেদা জিয়া বার বারই সেটা প্রত্যাখান করেছেন।
গত ১ অক্টোবর বিএনপির তিন সংসদ সদস্য উকিল আব্দুস সাত্তার, হারুনুর রশীদ ও আমিনুল ইসলাম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। ফিরে এসে হারুনুর রশীদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আজ মুক্তি পেলে কালই ম্যাডাম বিদেশে যাবেন চিকিৎসার জন্য।’
তার এই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গুঞ্জন ওঠে— সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে মুক্তি পাচ্ছেন খালেদা জিয়া। চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন বিদেশে।
পরদিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান বিএনপির চার সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান, জি এম সিরাজ, মোশাররফ হোসেন ও রুমিন ফারহানা।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ‘আজ মুক্তি পেলে কালই ম্যাডাম বিদেশে যাবেন চিকিৎসা নিতে’— হারুনুর রশীদের এই বক্তব্য খালেদা জিয়ার কাছে হুবহু তুলে ধরেন একজন সংসদ সদস্য। এতে খালেদা জিয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘এমন কথা তো আমি কখনো বলিনি। আগে আমার মুক্তি। তারপর আমি পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’
সংসদ রুমিন ফারাহানা প্যারোলের বিষয়টি তুললে খালেদা জিয়া সাফ জানিয়ে দেন, বেল (জামিন) তার প্রাপ্য। তিনি কোনো অবস্থাতেই প্যারোল নেবেন না। এ ব্যাপারে যেন আর কোনো কথা না হয়।
ওই দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলীয় সংসদের কথাপোকথন সম্পর্কে জানতে চাইলে বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন বুধবার (১৬ অক্টোবর) সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তি পেলেই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার যে আলোচনা হচ্ছিল বাইরে, সে ব্যাপারে আমি ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ম্যাডাম তখন জানিয়েছিলেন, তিনি এমন কথা কাউকে বলেননি। আর প্যারোলের ব্যাপারে ম্যাডাম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি জামিন চান, প্যারোল নয়।’
দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে খালেদা জিয়ার প্যারোল প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে তিনি বলেছিলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। ওদিক (সরকার) থেকে যদি কোনো প্রস্তাব আসে, তাহলে দলীয় ফোরামে বিষয়টি আমরা আলোচনা করব। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো— হার লাইফ ইজ ইমপরট্যান্ট ফর আস।’
আরও পড়ুন-
প্যারোলে মুক্তি নিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ভিন্নমত
খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি দলের নয়, পরিবারের বিষয়: ফখরুল
প্যারোলে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয় ভেবে দেখবে সরকার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আলোচনা হতে পারে: ওবায়দুল কাদের