‘পোলারে কইছিলাম, সন্ধ্যায় বেলুন কিন্যা দিমু’
৩১ অক্টোবর ২০১৯ ০০:১৯
ঢাকা: রিকশা চালাই। দুপুরে ভাত খাইতে ঘরে আইছিলাম। ঘরে কোনো খয়রাতি নাই, মানে চাইল-তরকারি কিছুই নাই। বউ কইতেছিল, রিকশা চালাইতে যান না কেন? কইলাম, আমার তো শরীরটা খারাপ, পারলে কিছু হাওলাত কইরা আনো। বউ কয় পারুম না। তাই গাড়ি লইয়া বাইর হইছি। বড় পোলায় পিছে দিয়া বাইর হইছে। গ্যাস দিয়া যেইখানে বেলুন বানায়, সেইখানে গিয়া বলে একটা বেলুন কিন্যা দেওয়ার জন্য। আমি কইলাম, বাবা, আমার তো টেকা নাই, সন্ধ্যায় আইয়া কিন্যা দিমু। কইলাম, বাসায় যাও। চইলা গেলো, আবার আইলো। কিন্তু আমি তো গাড়ি লইয়া বাইর হইয়া গেছি। ১১ নাম্বার থেইকা ১০ নাম্বারে গেলাম গাড়ি লইয়া। সেইখানে যাইতেই শব্দ পাইছি, আইসা দেখি আমার পোলা দুই টুকরা হইয়া আছে। চিকিৎসার সময়ও পাই নাই।
রাজধানীর রূপনগরে বেলুন ফোলানোর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারানো ১২ বছর বয়সী রুবেল ইসলামের বাবা নূর ইসলাম কথাগুলো বলছিলেন সারাবাংলাকে। বুধবার (৩০ অক্টোবর) রাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। সন্তানের লাশের জন্য সেখানেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি।
নূর ইসলামদের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনে। একমাসে আগেই তিনি ঢাকা আসেন সপরিবারে। চার সন্তানের মাঝে দ্বিতীয় সন্তান জিয়াদকে হারিয়েছেন গত বছরে, গ্রামের বাড়িতে পুকুরে ডুবে মারা যায় ৯ বছর বয়সী জিয়াদ। রুবেল ছিল সবার বড়। অন্য দুই ছেলের নাম আকবর ইসলাম ও আজগর ইসলাম।
শারীরিকভাবে অসুস্থ নুর ইসলামের শরীরে দুইবার অস্ত্রোপচার হয়েছিল বরিশালে। ঢাকায় এসেছিলেন ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। ভেবেছিলেন ছেলেকে পড়ালেখা করাবেন। স্কুলেও ভর্তি করিয়েছিলেন। তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিল ছেলেকে পড়ালেখা করাব, যাতে চাকরি করতে পারে। ভবিষ্যতে যাতে আমার মতো রিকশা চালাতে না হয়।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গের সামনে রুবেলের মা-বাবা
পাশে ছিলেন রুবেলের মা ফারজানা। তিনি জানালেন, সচরাচর সেই মাঠে বেলুনওয়ালাকে দেখা যায় না। কিন্তু আজ ছেলে বেলুন দেখে আবদার করেছিল। আর সেই বেলুন বানানো গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণেই হারাতে হলো সন্তানকে। এসময় নুর ইসলাম জানান, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে যে ব্যক্তি বেলুন বানাচ্ছিল, ঘটনাস্থলে গিয়ে আর তাকে পাওয়া যায়নি।
পাশেই ছিলেন রুবেলের খালা পারভিন। তিনি জানান, বিস্ফোরণের বিকট শব্দকে প্রথমে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণের শব্দ বলে মনে করেন। তবে শব্দ শুনতে পাওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে গেলে ভুল ভাঙে তার। হতাহতের শিকার শিশুদের রক্তাক্ত শরীরগুলো দেখতে পেয়ে অভিভাবকদের সন্ধান করছিলেন তিনি। এসময় তার স্বামী তাকে বলেন, ‘মানুষের বাচ্চার খবর যে নিচ্ছ, আমাগোর রুবেল কৈ?’ স্বামীর এ কথার পর দু’জন মিলে খুঁজতে থাকেন রুবেলকে, একসময় তার ছিন্নভিন্ন শরীরও শনাক্ত করতে পারেন তারা।
রূপনগরের এই দুর্ঘটনায় নুর ইসলামদের নিকটাত্মীয় আরেক মেয়ে শিশুও মারা গেছে। ছয় বছর বয়সী মেয়েটির নাম ফারজানা। পারভিন বলেন, ফারজানা আর রুবেল খেলতে বের হয়েছিল। বেলুন দেখেই বাচ্চারা সবাই ছুটে গিয়েছিল। যে বানাচ্ছিল, সে ছিল মাঝখানে। ওইখানে যতগুলো বাচ্চা ছিল, সবাই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তবে ওই বেলুনওয়ালাকে এই এলাকায় আগে কখনো দেখা যায়নি বলে জানান পারভিন।
ফারজানার ভাই আবদুর রহমানও হাসপাতালে ছিলেন নূর ইসলামের পাশেই। একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন তিনি। জানান, পাঁচ বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে ফারজানা সবার ছোট। স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত সে। আবদুর রহমান বলেন, ছোট ভাইয়ের কাছে ঘটনা শোনার পর ছুটে যাই। গিয়ে দেখি ফারজানা আর নাই। ফারজানার সঙ্গে খেলতে যাওয়া রুবেলও আর নাই। একই দুর্ঘটনায় ফারাজানার আরেক বোন মরিয়ম ও আবদুর রহমানের শ্যালিকা সুমাইয়াও আহত হয়েছে বলে জানান তিনি।
আবদুর রহমানের আরেক ভাই রাসেল। ফারজানার চেয়ে একটু বড় বয়সে। তবে ফারাজানা-রুবেলদের সঙ্গেই খেলাধুলা করে। ঘটনাক্রমে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সময় তাদের সঙ্গে ছিল না রাসেল। সে জানায়, বিস্ফোরণের পর সে গিয়েছিল ওই মাঠে। সেখানে গিয়ে মরিয়মকে আহত অবস্থায় ছটফট করতে দেখতে পায়। অন্যদের সঙ্গে বোনকে নিয়ে ছুটে আসে হাসপাতালে। পরে জানতে পারে, আরেক বোন ফারজানা আর বেঁচে নেই।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল আট বছর বয়সী মিরাজুল। সে জানায়, ‘সবাই বেলুন কিনতে ভ্যানের আশপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেলুনওয়ালা গ্যাস ভরার সময়ে একটা বিশাল শব্দ পাই। তারপর আর কিছু মনে নাই।’
বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রূপনগরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তিন শিশুসহ মোট পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, রূপনগরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় আমাদের এখানে প্রথমে ১২ জন এসেছিল। তাদের মধ্যে পাঁচ শিশুর মরদেহ এসেছে। এছাড়া আহত অবস্থায় আরও পাঁচ জন এসেছিল। তাদের মধ্যে তিন জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বেলুনে গ্যাস ভরার ওই সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ শিশু— রমজান (৮), নুপুর (৭), শাহীন (৯), ফারজানা (৬) ও রুবেল (১২)।