ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন: আদালতের যুগান্তকারী নির্দেশনা
৩১ অক্টোবর ২০১৯ ১৬:৪৫
চমৎকার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। জনস্বার্থে করা ব্রেস্ট ফিডিং রুম ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত ২৪ অক্টোবর আদালতে একটি রিট করেন তিনি। নিজের ৯ মাস বয়সী শিশু উমাইর বিন সাদীর পক্ষে করা এই রিটে কর্মক্ষেত্র, শপিংমল, এয়ারপোর্ট, বাস ও রেলওয়ে স্টেশনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। রিটে বলা হয়, এমন পরিবেশে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করতে হবে, যেখানে কোনো মা সন্তানকে বুকের দুধ পান করাতে অস্বস্তি বোধ করবেন না বা যৌন হয়রানির শিকার হবেন না। নয় মাসের শিশুর রিট করার মধ্যে হয়তো চমক আছে। কিন্ত এর চেয়ে বড় কথা হলো, তার যে অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তা সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া।
২৭ অক্টোবর ইশরাত হাসানের ওই রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একটি রুল জারি করেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। দেশের সব কর্মক্ষেত্র, এয়ারপোর্ট, বাস ও রেলওয়ে স্টেশনে এবং শপিংমলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। এছাড়াও পাবলিক প্লেস ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনে নীতিমালা তৈরি করতে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদেরকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
রিটকারী ইশরাত হাসানের একটি সাক্ষাৎকার ৭১ টিভিতে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কিছুদিন আগে কক্সবাজার থেকে ফেরার সময় যাত্রা বিলম্বের কারণে তাকে প্রায় ৫ ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দীর্ঘ সময় তার সন্তানকে ফিডিং করানোর মত কোনো জায়গা পাচ্ছিলেন না তিনি। পরে নারীদের নিরাপত্তা চেক করার জন্য নির্ধারিত পর্দা দিয়ে ঢাকা ছোট জায়গাটিতে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে অল্প সময়ের জন্য বাচ্চাকে ব্রেস্টফিডিং করান তিনি। ভুক্তভোগী একজন মা হিসেবে তিনি মনে করেন, তার সন্তান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তার মতো আরও অনেকেই কর্মস্থলে বা বাস ও ট্রেন স্টেশনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন। একজন নারী তার সন্তানকে নিয়ে দীর্ঘসময় যখন বাইরে থাকেন কিংবা কোথাও লম্বা সময় নিয়ে কোনো পরিবহনে যেতে হয়, তখন শুধুমাত্র নিরাপদ পরিবেশের অভাবে কিংবা যৌন হয়রানির ভয়ে শিশুকে দুধপান করানো থেকে বিরত থাকেন। এতে তিনি শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। একজন শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধি এবং পুষ্টির জন্য যেমন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মায়ের বুকের দুধ। এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পাশাপাশি একজন মায়ের জরায়ু ও স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। কেবলমাত্র নিয়মিত ব্রেস্ট ফিডিং করানোর মাধ্যমে এসব রোগের হার একেবারেই কমিয়ে আনা সম্ভব।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবছর আগস্টের ১ থেকে ৭ তারিখ বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়ে থাকে। ২০১০ সাল থেকে আমাদের দেশেও দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। সুস্থ, সুন্দর ও সবলভাবে শিশুর বেড়ে ওঠায় এবং নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে সরকারি-বেসকারি প্রতিটি কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার ও ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপর ৯ বছর অতিবাহিত হলেও এক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনও উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি। বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে কর্মজীবী মায়েদের জন্য নেই ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার। আমার নিজের অভিজ্ঞতাই দেখেছি, বড় বড় শপিংমলগুলোতে ফিডিং কর্নার থাকলেও সবগুলো সচল নয়। এর মধ্যে কোনো কোনোটি অপরিস্কার; রয়েছে আলোর স্বল্পতাও। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশানে বেসরকারি উদ্যোগে একটি ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপন করা হলেও তার যথাযথ রক্ষাণাবেক্ষণ হচ্ছে না। কিছু কিছু ব্যাংক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং এনজিও নিজ উদ্যোগে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার করলেও দেশের সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম।
নারী ও শিশু কল্যাণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো এরই মধ্যে আন্তজার্তিক বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। তাই বলা যেতে পারে, আদালতের রুলের উত্তর দিতে এবং নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেহেতু কর্মজীবী মায়েদের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে, তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও উদ্যোগেী হতে হবে। আমাদের বৈষম্যমূলক অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
লেখক: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন