Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘জীবন-সংসার বলতে বুড়িগঙ্গাকেই বুঝি’


৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৩:০১

ঢাকা: সবকিছু হারিয়ে প্রায়ই পথে বসে যাওয়ার উপক্রম। তখন আমি জীবিকার খোঁজে বরিশাল থেকে চলে আসি ঢাকায়। প্রথমেই এসেই বুড়িগঙ্গায় নদীর পাড়ে ছোট একটি দোকান বসাই। আয়-রোজগার ভালোই হচ্ছিল। কিছুদিন যাওয়ার পর ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নটি আবার দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। স্থানীয়রা আমার ছোট দোকানটি উঠিয়ে দিল।

এরপর একজনের পরামর্শে একটি পরিত্যক্ত নৌকা কিনি। সেটি ঠিকঠাক করে ওই নৌকাতেই সাজাই দোকান। সেই থেকে আমি বুড়িগঙ্গার ভ্রাম্যমাণ দোকানি। থাকা-খাওয়া ঘুম সবই এ নদীর উপরে। বুড়িগঙ্গা নদীও আমার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন।

বিজ্ঞাপন

কথাগুলো বলেছিলেন বুড়িগঙ্গার ভ্রাম্যমাণ দোকানি মো. ওমর (ছদ্মনাম)। ওমরের গ্রামের বাড়ি বরিশাল। বিয়ের পর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বনাবনি না হওয়ার ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশায় ঢাকার উদ্দেশে পাড়ি জমান ওমর। যান্ত্রিক শহরেই এসে পড়ে যান বিপাকে। তখন টাকা-পয়সা কম থাকায় বাধ্য হয়ে বুড়িগঙ্গায় আশ্রয় নিতে হয় তাকে।

ওমর বলেন, ‘নদীর পাড়ে ছোট একটি ঝুপড়িঘরে বসবাস শুরু করি। সেই থেকে ১০ বছর ধরে এই নদীর সংস্পর্শে বেঁচে আছি।’

ওমরের মতই ওয়াজঘাটের মাঝি রাফাত আলী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ২০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় নদীর সঙ্গে আছি। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আবার ভোর হওয়ার আগে জেগে উঠি। সবকিছু বাদ দিয়ে প্রতিদিন পাঁচশ টাকার ওপর আয় হয়। যা দিয়ে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের জন্য গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘আমার মতো অনেক মাঝি আছে। তারাও নদীর পাড়ে নৌকার ওপর খায়-ঘুমায়। আমাদের সবকিছুই বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে। জীবন-সংসার বলতে বুড়িগঙ্গাকেই বুঝি।’

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে চার থেকে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ দোকান রয়েছে। দোকানগুলোতে শুকনো খাবার, ভাত-রুটি পাওয়া যায়।

বুড়িগঙ্গার তেলঘাটে দোকানি হেলাল উদ্দিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ঘাটে স্থায়ীভাবে দোকান নিয়ে থাকতে দেয় না। যখন ওরা তাড়িয়ে দেয় তখন দোকানটি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই। আবার পরের দিন চলে আসি।’

ওই দোকানি বলেন, ‘এখানে দোকান রাখার জন্য টোল দিতে হয়। এ ছাড়া প্রতিমাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। তারপরও ভালো আছি। বেকার বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা নিয়ে আছি। এখানে যারা কাস্টমার তারা হয় নৌকার মাঝি না হয় নৌকার যাত্রী।’

বুড়িগঙ্গায় নৌকা তৈরির কারিগর সবুজ মিয়া। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার জন্ম কেরানীগঞ্জ কদমতলীতে। নৌকা তৈরি ও মেরামতের কাজ করে এখানে জীবিকা নির্বাহ করি। ছোট থেকে কেবল এ কাজটি করতে পারি। এ ছাড়া অন্য কোনো কাজ শিখিনি। এ জন্য বুড়িগঙ্গা নদী আমার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা।’

তেলঘাটের মাছ ব্যবসায়ী রতন লাল বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন রকমের মাছ নিয়ে জেলেরা বুড়িগঙ্গার তীরে আসে। মাছগুলো ঢোকার আগেই জড়ো হয় কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন ঘাটে। এখান থেকে আমরা সব মাছ সাপ্লাই দিই। বর্তমানে এ কাজ করে আমার পরিবার খাবার জোগাচ্ছে।

ঠাঁই মেলে নদীর বুকে 

রাজধানীর বুকে একেবারে যাদের থাকার জায়গাটুকু নেই বললেই চলে তাদের ঠাঁই হয় বুড়িগঙ্গায় নদীর বুকে। খুব সস্তায় বুড়িগঙ্গার বুকে ভাসমান হোটেল ও নৌকাগুলোতে রাত কাটানো যায়।

বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে থাকে বেশকিছু আবাসিক নৌকা। যা স্থানীয় মানুষদের কাছে ভাসমান হোটেল বা বোর্ডিং নামে পরিচিত। নিম্নশ্রেণির মানুষেরা সারাদিন পরিশ্রম করার পর বিশ্রামের জন্য বুড়িগঙ্গার আশেপাশে মাঝিরা তাদের নৌকাতেই ঘুমিয়ে পড়েন। এছাড়া যাদের নিজস্ব কোনো নৌকাও নেই তাদের সর্বশেষ ঠাঁই মেলে এ বোর্ডিংগুলোতে। আগে এগুলো ওয়াইজঘাটে থাকলেও বর্তমানে এর অবস্থান নবাববাড়ি সংলগ্ন বাদামতলি মসজিদ ঘাটে।

জানা যায়, স্বাধীনতার পরপরই ভাসমান বোর্ডিংগুলো স্থাপন করা হয়। তবে হোটেলগুলো নদীতে থাকলেও সাধারণত ভেসে বেড়ায় না। রাত ১০টা থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত যে কেউ এ হোটেল ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবেন। তবে হোটেলের সিট বুকিং নিতে হবে বিকেল ৪টার মধ্যে। পাশাপাশি অবস্থানরত একেক বোর্ডিংয়ে রাত কাটানোর জন্য দিতে হয় একেকরকম ভাড়া। ভাড়ার তারতম্যের কারণে সেবায়ও থাকে তারতম্য।

বর্তমানে বুড়িগঙ্গায় পাঁচটি বোর্ডিং। শরীয়তপুর বোর্ডিং, ফরিদপুর মুসলিম হোটেল, উজালা বোর্ডিং ইত্যাদি। প্রতিটি বোর্ডিংয়ে ৪০ টাকা ১০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া রাখা হয়। প্রতিটিতে রয়েছে ৪০ থেকে ৫০টির মতো কেবিন। প্রতিটি কেবিনে রয়েছে বিদ্যুৎ, লাইট ও ফ্যানের ব্যবস্থা। এছাড়া রয়েছে গোসলখানা ও টয়লেটের ব্যবস্থা। যদিও এগুলো তেমন মানসম্মত নয়।

চাঁদপুর থেকে খুচরা মালামাল বিক্রয় করার জন্য প্রায়ই সদরঘাটে আসেন পারভেজ মিয়া। তিনি সারাবাংলাকে ববেলন, ‘আমি খুচরা ব্যবসায়ী। তাই মালামাল বিক্রয় করতে দুই-একদিন সময় লাগে। ভালো হোটেলে উঠতে গেলে অনেক টাকা খরচ। সেই তুলনায় সদরঘাটের বোর্ডিগুলো একেবারে সস্তা। কম খরচে ব্যবসায় লাভ করে বাড়ি ফিরতে পারি।’

বুড়িগঙ্গা শরীয়তপুর বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার মো. সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে যারা রাত কাটান তাদের বেশিরভাগই রিকশাচালক, ভ্যানচালক, মাঝি বা দিনমজুর। এখানে থাকার জন্য সর্বনিম্ন ৪০ টাকা থেকে ১০০ টাকা রাখা হয়। আমাদের বোর্ডিংগুলোতে গোসল-বাথরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। যে কেউ চাইলে টাকার বিনিময়ে এগুলো ব্যবহার করতে পারবেন।’

জীবিকা নদী বুড়িগঙ্গা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর