পিইসি-জেএসসি বন্ধের পক্ষে মত ভিকারুননিসা অধ্যক্ষ ফওজিয়ার
৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ২০:৪২
ঢাকা: শিশু শিক্ষার্থীদের দুই পাবলিক পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) শিশুদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তেমন ভূমিকা রাখছে না বলে মন্তব্য করেছেন বেইলি রোড শাখা ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফওজিয়া।
তিনি বলছেন, এই দুই পরীক্ষা শিশুদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে। এর ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে এর পরিবর্তে শিশুদের জন্য বিনোদনের মাধ্যমে পড়ালেখার ব্যবস্থা তৈরির পক্ষে মত দেন রাজধানীর অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ।
আরও পড়ুন- ‘ফলাফল নিয়ে উন্মাদনা বন্ধে গ্রেডিং পদ্ধতিতে সংস্কার আনা হবে’
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) এ বছরের পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অধ্যক্ষ ফওজিয়া সারাবাংলাকে এসব কথা বলেন।
এ বছর ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেইলি রোড শাখা থেকে জেএসসিতে মোট ২ হাজার ১১৮ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে পাস করেছে ২ হাজার ১১৫ জন। পাশের হার ৯৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। জিপিএ ফাইভ পেয়েছে ৮৫৩ জন, যা পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মোট পরীক্ষার্থীর ৪০ শতাংশ। এদিকে, পিইসি পরীক্ষায় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অংশ নেওয়া শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৮৭৬ জন।
ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বরাবরই বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় এমন ভালো ফল করে আসছে। নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমন ফলে অধ্যক্ষ ফওজিয়া সন্তুষ্ট। তবে শিশুদের দুই পাবলিক পরীক্ষাও ‘রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড’ হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব ক্ষতিকর বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক ফওজিয়া বলেন, এখনকার অভিভাবকরা জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য সন্তানদের অতিরিক্ত চাপ দেন। দেখা যায়, স্কুলের পাশাপাশি অতিরিক্ত কোচিং ও গৃহশিক্ষক রাখা হয়। এভাবে শিশুরা সারাক্ষণই পাঠ্যপুস্তকে আটকে থাকে এবং কোনো ধরনের বিনোদন উপভোগের সুযোগ তাদের থাকে না। এত অল্প বয়সেই শিশুদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এবং তাতে ফল ভালো করার চাপ তাদের মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অভিভাবকরা তাদের শিশুদের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যান, এতে করে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
শিশুদের ওপর পড়ালেখা ও ফল ভালো করার এই চাপ নিরসনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কতটুকু— এমন প্রশ্নের জবাবে ভিকারুননিসা অধ্যক্ষ বলেন, অবশ্যই প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে যেমন লেখাপড়ার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত রাখা হয়। শিক্ষার সঙ্গেও যেন বিনোদন থাকে, এটি প্রতিষ্ঠানকেই নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাসায় যেহেতু সবাই শিশুদের খোলামেলা পরিবেশ দিতে পারছি না, তাই স্কুলে খেলার মাঠ ও খেলাধুলা করার সুযোগ দেওয়া জরুরি। সহশিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলেই শিশুদের জন্য খেলাধুলা করার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা শিশুদের মেধা বিকাশে তেমন কাজে আসে না বলে মনে করেন অধ্যাপক ফওজিয়া। তাই এই দুই পরীক্ষা বন্ধ করার পক্ষে মত তার। তিনি বলেন, আমরা বা আমাদের সমসাময়িক যারা, আমরা শৈশবের এই পাবলিক পরীক্ষা না দিয়েও সাফল্য পেয়েছি। ভবিষ্যৎ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বরং এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্কুল পর্যায়ে শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমাতে এই দু’টি পরীক্ষা বন্ধ হওয়া উচিত। এ বিষয়ে সরকার থেকে পদক্ষেপ নেবে— এমন আশাবাদ তার।
কী বলছে শিশু শিক্ষার্থীরা
পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করতে শিশুদের চাপে রাখা হয়— ভিকারুননিসা অধ্যক্ষের এমন বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া গেল শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেও। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার্থী বেশ কয়েকটি শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্কুল ও কোচিংয়ের ফাঁদে আটকে পুরো একটা বছর লেখাপড়া ছাড়া আর কোনোকিছুরই সুযোগ পায়নি অনেকে। একাধিক শিক্ষার্থী জানালো, গত একবছর তারা শুধু পাঠ্যপুস্তকেই আটকে ছিল। খেলাধুলা, নাচ, গান, ছবি আঁকা কিংবা গল্পের বই পড়ার অবসর মেলেনি তেমন। সকালে স্কুল, তারপর কোচিং, বাসায় গৃহশিক্ষক— এর ফাঁকে নিজের মতো করে সময় কাটানোর ফুসরত পায়নি তারা। তাদের কমবেশি সবার জন্যই লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল একটিই— জিপিএ-৫ পেতে হবে পরীক্ষায়।
তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। কয়েকটি শিশুর সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, জিপিএ-৫ পেতেই হবে, এমন চাপ ছিল না তাদের ওপর। এমন শিশুরা পড়ালেখার পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার সময় বের করে নিতে পেরেছে। কেউ কেউ খেলাধুলা বা অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমেও যুক্ত ছিল। সামনে পিইসি বা জেএসসি পরীক্ষা বলে দিনরাত বইয়ে ডুবে থাকতে হয়নি তাদের।
অভিভাবকরা কী বলছেন
শিশুদের মন্তব্যের প্রতিফলন পাওয়া গেল অভিভাবকদের বক্তব্যেও। তাদের কেউ কেউ অধ্যক্ষ ফওজিয়ার বক্তব্যের সঙ্গে একমত— শিশুদের দুই পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ হওয়া উচিত। তবে কেউ কেউ বলছেন, সামাজিক কারণেই শিশুদের ভালো ফলের জন্য চাপ দেওয়া হয়ে থাকে।
সোমা নামে একজন অভিভাবক জানান, তার মেয়ের ওপর জিপিএ-৫ পাওয়ার কোনো চাপ ছিল না। পেশায় আইনজীবী সোমা সারাবাংলাকে বলেন, আমার সন্তান যে ফলই করুক না কেন, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। তারপরও যেহেতু পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, ভালো ফল করবে— এমন বাড়তি একটু চাপ তো ছিলই।
আরও পড়ুন- জেএসসিতে পাস ও জিপিএ-৫ বেড়েছে
সোমা মনে করেন, পরীক্ষার ফল গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তবে শিশুদের পূর্ণ বিকাশের জন্য পাঠ্যপুস্তক যথেষ্ট নয়। তাই সন্তানকে গল্পের বই কিনে দেন তিনি। শিশুদের পাবলিক পরীক্ষা বন্ধের পক্ষেও মত তার। সোমা বলেন, পাবলিক পরীক্ষা হওয়ায় একটু চাপ থাকেই। তাই শিশুদের উন্মুক্ত শৈশব নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ করা উচিত।
কয়েকজন অভিভাবক বললেন, শিশুদের ভালো ফল করতেই হবে— এই চাপ অনেকটাই সামাজিক। পাবলিক পরীক্ষা বলে এই চাপ একটু বেশিই থাকে। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা না থাকলে এই চাপ অনেকটাই কমে যাবে।
একজন অভিভাবক জানালেন, তার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে পড়ালেখা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেত। এ কারণে গত একবছর নাচ বন্ধ রাখতে হয়েছে। তিনিও স্কুল পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষা বন্ধের পক্ষে মত দেন।
আরও পড়ুন-
৩৩ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেনি
জেএসসি-জেডিসিতে পাসে এগিয়ে ছাত্রীরা
মোবাইল ফোনেও জানা যাচ্ছে পরীক্ষার ফল
জেএসসি পিইসি ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিশু শিক্ষার্থী