বিএসএমএমইউ সমাবর্তন : ৪২ জন মিলে ব্যানার-সম্পাদকীয়তে এত ভুল!
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৪:৪৪
জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : চিকিৎসাবিদ্যায় পাশ করা ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর সনদ দেওয়ার জন্য সোমবার তৃতীয় সমাবর্তন করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লক মাঠে এই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তন উপলক্ষে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা, ভবন, গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সাজানো হয় বাহারি ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে। তবে এত আয়োজনের মধ্যে নজর কেড়েছে কিছু ভুল বানান এবং ভুল বাক্য। অথচ মুদ্রণ ও প্রকাশনার দিকগুলো তদারকির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়োজিত ছিলেন ৪২ জন শিক্ষক।
সমাবর্তন সফল করতে ১৭টি কমিটি-উপকমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে প্রকাশনা ও মুদ্রণ কাজ তদারকির দায়িত্বে ছিল দুই উপকমিটি। প্রচার বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন ১৮ জন। এর প্রধান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম মোস্তফা জামান।
অপর উপকমিটি প্রকাশনা ও মুদ্রণ উপকমিটির সদস্য ছিলেন ২৪ জন। এ উপকমিটির প্রধান কার্ডিওলজি বিভাগের অপর অধ্যাপক হারিসুল হক।
৪২ জনের দুই উপকমিটি মিলে সমাবর্তনের যে ব্যানার-ফেস্টুন করেছে তাতে বেশকিছু ভুল দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও।
দেখা যায়, একটি ফেস্টুনে লেখা রয়েছে, ‘উচ্চশিক্ষ’ লাভ ব্যক্তিকে জাতির কাছে দায়বদ্ধ করে তোলে। অথচ ‘উচ্চশিক্ষ’ বলে কোনো শব্দ নেই, শব্দটি হবে ‘উচ্চশিক্ষা’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে টাঙানো আরেকটি ফেস্টুনে লেখা হয়েছে, উচ্চশিক্ষা একটি জাতির ‘মেরুদন্ত’ যেখানে শব্দটি হবে ‘মেরুদণ্ড।’
তৃতীয় আরেকটি ব্যানারে লেখা হয়েছে, ‘চিকিৎসা একাধারে যেমন সেবা অন্যদিকে এক প্রকার কলাও বটে’। এই বাক্যটিতে রয়েছে মারাত্মক ত্রুটি। বাক্যটি হতে পারে, ‘চিকিৎসা একাধারে সেবা এবং কলা’ অথবা ‘চিকিৎসা একদিকে যেমন সেবা অন্যদিকে এটি এক প্রকার কলা’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক এসব ভুল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, দেশের একমাত্র সর্বোচ্চ চিকিৎসা বিদ্যাপীঠ এর সমাবর্তনের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের ব্যানারে একাধিক ভুল যেন আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার মারাত্মক ধ্বংসের কথা জানান দিয়ে যাচ্ছে।
একইসঙ্গে সমাবর্তন উপলক্ষে করা সুভ্যেনিয়রে লেখা সম্পাদকীয়তে রয়েছে অসংখ্য ভুল। সেখানে ১২ লাইনে কমপক্ষে রয়েছে ২৫টি ভুল। সাধারণ চিকিৎসকরা বলছেন, ভাষায় দক্ষতা রয়েছে এমন কাউকে দিলে এ সম্পাদকীয়তে আরও অনেক ভুল বের হবে।
সাধারণ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমাবর্তনে এসব ভুল খুব সহজেই নজর কাড়বে এটিই স্বাভাবিক। কারণ এই ভুলগুলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশা করিনি।
সমাবর্তনের প্রতিটি বিষয় হতে হবে নিখুঁত এবং নির্ভুল। অথচ ভুল বানানে লেখা, শব্দচয়নের ভুল বিষয়গুলো কেউ খেয়ালই করেনি। এই যদি প্রকৃত অবস্থা হয় তাহলে সেটি খুবই দুঃখজনক।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ব্যানারগুলোর ভুল নিয়ে নিজের ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডা. জাহিদুর রহমান। তিনি ফেসবুকে লেখেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ব্যানারে এরকম স্থূল, হাস্যকর রকমের ভুল কীভাবে হয়? প্রিন্টিং মিসটেক হতেই পারে, কিন্তু মুদ্রণপ্রমাদ দেখার জন্য কী একজনও কি নেই?
ডা. জাহিদুর রহমান আরও লেখেন, ‘সমাবর্তন হবে ১৯ তারিখে এবং তখনও ভুল সংশোধন করার সময় ছিল জানিয়ে তিনি গত ১৮ ফেব্রুয়ারি লেখেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশা করি আজ (১৮ ফেব্রুয়ারি রাত) রাতের মধ্যেই এগুলো সংশোধন করে নেবেন। সমাবর্তনে এ ব্যানারগুলোর সামনে হাজার হাজার ছবি তোলা হবে, সেগুলো ফেসবুকে আসবে, আজকে হাজার মানুষ দেখলে কাল থেকে লাখ লাখ মানুষ দেখবে।’
সম্পাদকীয় লেখার ছবি তুলে ধরে একাধিক চিকিৎসক বলছেন, কত ভুল ধরবেন? বরং কয়টা শুদ্ধ আছে, সেটা খুঁজে দেখতে পারেন। কিন্তু কথা অন্য জায়গায়, বিষয়টা নতুন না, বর্তমান প্রশাসনের নগ্ন স্বজনপ্রীতির কারণে গুটিকয়েক সুযোগ-সন্ধানী প্রতিষ্ঠানের বড় সব অর্জন ধ্বংস করে দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমাবর্তন ঘিরে তিন মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন শেষ হয় ডিসেম্বরে। তিন মাস সময় পাওয়ার পরও এ সব ভুল অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ চিকিৎসকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র সারাবাংলাকে জানায়, প্রচার-প্রকাশনার সামগ্রিক বিষয় দেখাশোনায় ছিলেন মেডিকেল অফিসার সমরেশ চন্দ্র সাহা। কিন্তু কমিটিতে তার নাম নেই।
নিজের নাম না থাকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কমিটিতে অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকরা থাকেন। কিন্তু আমি মেডিকেল অফিসার হওয়ায় প্রটোকল অনুযায়ী তার নাম ছিল না।
ব্যানারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘জাস্ট তিন টা জায়গায় সমস্যা হয়েছে। তিনটার মধ্যে একটা শব্দ তারা বোঝে নাই। একটা প্রিন্টিং মিসটেক হয়ে গেছে। তখন একজন স্যার জানালেন আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা সরিয়ে ফেলেছি।’
‘দায়িত্ব তো একা আমার না, এটি ইউভার্সিটির। আমার ডাক্তার (যারা ফেসবুকে এগুলো নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন) তাদেরও তো দায়িত্ব আছে। এটা ইয়ে হয়ে গেছে। এত বড় কাজের মধ্যে দুই একটা প্রিন্টিং মিসটেক হতেই পারে। আরও একটু সময় পেলে ভালো করতে পারতাম।’
সুভ্যেনিয়রে সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সম্পাদকীয় লিখেছেন দুই বাংলার বিখ্যাত কবি হারিসুল হক। উনার ভাষা অনেক সময় অনেকে বুঝতে পারে না, এটাও হয়ত একটা প্রবলেম হতে পারে।’
ভুল বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু ভুল তো থাকতেই পারে। আমার লেখায় ভুল থাকতে পারে, থাকতে পারে না? যদি কেউ ভুল নিয়ে কথা বলতে চায় বলুক। অসুবিধা কী?’
ফেস্টুন-সম্পাদকীয়তে ভুল বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসলে কেউ ভুল ব্যানারের ছবি তুলে ফেসবুকে দিত না, তারা আমাদের জানাত। আর তিন হাজার ব্যানারের মধ্যে তিনটি ব্যানারে ভুল হতেই পারে।’
পরে ব্যানার নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশকারী একজন চিকিৎসককে প্রক্টর হাবিবুর রহমান দুলালের মন্তব্যের কথা জানালে তিনি বলেন, ‘তাদের আগেই বলা হয়েছে, কিন্তু তারা সরায়নি।’
সমাবর্তনের মাধ্যমে ১ হাজার ২০২ জন চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রির সনদ নেন। তাদের মধ্যে মেডিসিন অনুষদ থেকে ৩৪১ জন, সার্জারি অনুষদ থেকে ৩৮৮ জন, বেসিক সায়েন্স ও প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদ থেকে ২৪১ জন, ডেন্টাল অনুষদ থেকে ৫০ জন, প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন অনুষদ ধেকে ১৪০ জন চিকিৎসক ও নার্সিং অনুষদ ধেকে ৪২ জন ডিগ্রিধারি নার্স তাদের সনদ নেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪২টি অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর কোর্সের সংখ্যা ৯৫টি। এরমধ্যে রেসিডেন্সি ৬২টি, নন রেসিডেন্সি ৩০টি, বিএসসি নার্সিং ১টি, মাস্টার অফ সায়েন্স ইন নার্সিং ১টি এবং পিএইচডি ১টি। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর ২ হাজার ২৭৪ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। এরমধ্যে রেসিডেন্সি ১ হাজার ৯৯ জন এবং নন রেসিডেন্সি ১ হাজার ১৭৫ জন।
এর আগে ২০১১ সালে প্রথম ও ২০১৫ সালে দ্বিতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।
সারাবাংলা/জেএ/একে