হেলমেটেও ছড়াতে পারে জীবাণু, সাময়িক সমাধান মাস্ক
১১ মার্চ ২০২০ ০০:২০
ঢাকা: বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে প্রায় সব দেশই গণপরিবহন ব্যবহার করতে নিরুৎসাহিত করছে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রমও নয়। তবে গত বছরখানেক সময়ে গণপরিবহনের বদলে রাইড শেয়ারিংকে অনেকেই বেছে নিয়েছেন যাতায়াতে। এর মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং। আর এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেলে রাইডারের জন্য রাখা হেলমেট নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা। ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস সংক্রমণে হেলমেটের ব্যবহার নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। কেবল করোনাভাইরাস নয়, যেকোনো ধরনের রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেই হেলমেটের ভূমিকা হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের শিক্ষক রাজীব শিকদার। প্রতিদিন উত্তরা থেকে বনানী যাতায়াত করতে রাইড শেয়ারিং সেবা ব্যবহার করেন। তবে প্রতিদিনই চালকের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হয় হেলমেট ব্যবহার করা নিয়ে।
রাজীব শিকদার সারাবাংলাকে বলেন, এখানে যে হেলমেটগুলো ব্যবহার করা হয়, তা শুধুমাত্র মামলা থেকে বাঁচার জন্য। অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো হয়ে থাকে প্রচুর দুর্গন্ধযুক্ত ও ময়লা। আর এগুলো কতটুকু সুরক্ষা দেবে, তা তো দুর্ঘটনা হলে সবাই দেখে।
প্রায় একই অভিযোগ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার অধিবাসী শোভন চৌধুরীরও। প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার পথে ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস ব্যবহার করেন। কিন্তু হেলমেটের মান নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন তিনি।
শোভন চৌধুরী বলেন, আমাদের যে হেলমেটগুলো ব্যবহার করতে দেওয়া হয় সেগুলো আসলে কতটা মানসম্মত, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। একইসঙ্গে প্রায় সময়ই দেখা যায়, হেলমেটগুলো হয়ে থাকে দুর্গন্ধযুক্ত, ঘামে ভেজা অথবা ময়লা। অনেকেই হেলমেট রাখেন চাকার কাছে। চাকার ময়লাসহ রাস্তার বিভিন্ন রকমের জীবাণু সেখানে ছড়িয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। আমরা নিরুপায় হয়েই এই সেবা নিচ্ছি।
হেলমেটের রকমফের
বাংলাদেশে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের হেলমেটের ব্যবহার দেখা যায়। এর মধ্যে শুরুতেই আসবে হাফ হেলমেটের কথা। অনেকটাই বাচ্চাদের স্কুল ক্যাপের মতো দেখতে এই হেলমেটের মাথার ওপরের অংশ বাটির মতো। সামনের দিকে সামান্য শেড থাকতে পারে। দু’পাশে বেল্ট দিয়ে চিবুকের সঙ্গে থাকে লক লাগানোর সিস্টেম। মাথার ওপরের অংশ ঘিরে থাকা এই হেলমেটে মানুষের কান, থুতনি, মুখ ও চোখ অনিরাপদ অবস্থায় থাকে।
আরেক ধরনের হেলমেটকে বলা হয় ওপেন ফেস হেলমেট। সুরক্ষার বিচারে কিছুটা কার্যকর এই হেলমেটে মাথার প্রায় তিন চতুর্থাংশ ঢাকা থাকে। এই হেলমেটের সামনের অংশে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ঢাকনাটির কারণে সামনে থেকে আসা ধুলো-বালি থেকে চোখ-মুখকে রক্ষা করে।
অনেক বাইকেই ফুল ফেস হেলমেটও দেখা যায়। এ ধরনের হেলমেটে বাড়তি অংশ হিসেবে থুতনির সামনে প্রোটেকশন থাকে। ওপেন ফেস হেলমেটের থেকে সামনের স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ঢাকনা বা গ্লাসের সাইজ কিছুটা ছোট হয়। বাইরের শব্দ/ময়লা কম প্রবেশ করলেও পরিপূর্ণ সুরক্ষার কারণে এ ধরনের হেলমেট ব্যবহার প্রয়োজনীয় হলেও স্বাস্থ্যগত বিবেচনায় এই হেলমেট নিয়ে রয়েছে শঙ্কা।
এছাড়াও মডিউলার হেলমেট, অফ-রোড হেলমেট, ডুয়েল স্পোর্ট হেলমেটের মতো কিছু হেলমেটও দেখা যায়।
হেলমেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শঙ্কা
এই হেলমেটগুলোর কারণে আসলেই ভাইরাস বা অন্য কোনো জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় রাস্তাতে যেসব বাইক চলছে, যিনি চালাচ্ছেন তার হেলমেট নিজেই ব্যবহার করছেন। কিন্তু যাত্রীরা সবাই একই হেলমেট ব্যবহার করছেন। এ ক্ষেত্রে ফুল ফেস হেলমেটে থুতনিসহ মুখের অংশটি ঢাকা থাকায় এটি ব্যবহারের সময়ে যদি কেউ হাঁচি-কাশি দিয়ে থাকে, সেটার জীবাণু হেলমেটে থেকে যাবে। আরেকজন সেটা ব্যবহার করলে এই জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। সাধারণ ফ্লু থেকে শুরু করে করোনাভাইরাসও এর মাধ্যমে ছড়ানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে যে হেলমেটগুলো দেখা যায়, সেগুলোর অধিকাংশই স্বাস্থ্যসম্মত না। কিছু ক্ষেত্রে এগুলোর কারণে ছোঁয়াচে রোগ থেকে শুরু করে মাথার উকুনও ছড়াতে পারে। এছাড়াও ছড়াতে পারে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ। মাথার চামড়ায় যেসব রোগ হয়, ফাংগাসজনিত রোগ দেখা দিতে পারে। হাফ হেলমেটগুলো কোনোভাবেই নিরাপত্তা দেয় না আমাদের। আর এগুলোসহ ওপেন ফেস ও ফুল ফেস হেলমেটের ভেতরের দিকেও যে পরিমাণ ময়লা দেখা যায়, অনেক সময় তা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ আমাদের দেশে ধুলা-বালি অনেক বেশি। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা হেলমেট ব্যবহার করছেন বা যাত্রীদের ব্যবহার করতে দিচ্ছেন, তা একবছরেও পরিবর্তন হয় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় হেলমেট রাখার স্থান। অধিকাংশ সময়ে দেখা যায় হেলমেট রাখা হচ্ছে বাইকের চাকার দিকে কোনো কিছুর সঙ্গে ঝুলিয়ে। এতে করে ছড়াতে পারে যেকোনো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া।
এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হয়ে ওঠার আহ্বান জানান এই ভাইরোলজিস্ট। যাদের নিয়মিত বাইকে রাইড শেয়ারিং সেবা ব্যবহার করতে হয়, তারা সম্ভব হলে নিজের একটি হেলমেট সঙ্গে রাখতে পারেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, মুখের কাছাকাছি থাকে— এমন সবকিছুর মাধ্যমেই ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি আছে। এটা শুধু কভিড-১৯ নয়, যেকোনো ভাইরাসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হেলমেটে এই আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। কারণ একই হেলমেট একজন পরার কিছু সময় পর আরেকজন ব্যবহার করে থাকেন। কেবল ফুল ফেস হেলমেটই না, কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি হাফ হেলমেট পরা বা খোলার সময়ও সেটি ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ অবস্থায় সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন ডা. জাহিদুর। তিনি বলেন, সাময়িক সমাধান হিসেবে সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে যারা অসুস্থ অবস্থায় রাস্তায় বাইকে চড়ে থাকেন, তারা মাস্ক পরলে তাদের থেকে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা কমবে। আবার অন্য যাত্রীরা সেটা পরলে তখন তাদের মধ্যে ছড়ানোর ঝুঁকিও কমবে। তবে এটি দীর্ঘ মেয়াদে কোনো সমাধান নয়। কারণ হেলমেটের ভেতরের দিকে ময়লা মানুষের মাথার অংশে নানারকমের জীবাণু ছড়াতে পারে। যেসব রোগ ছোঁয়াচে বা ঘামের মাধ্যমে ছড়ায়, সেগুলোর ক্ষেত্রে এক হেলমেট একাধিকজনের ব্যবহার করা বিপদের কারণ হতে পারে।
হেলমেটকে রুমালের সঙ্গে তুলনা করে এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি একজনকেই ব্যবহার করতে হয়। একজনেরটা আরেকজন ব্যবহার না করাই ভালো। গরমের দিনে হেলমেটে যে পরিমাণ ঘাম লেগে থাকে, সেটিও ক্ষতির কারণ হতে পারে। দেখা গেল একজন আক্রান্ত রোগী হেলমেট ব্যবহার করলেন, পরে সেটি সারাদিনে আরও ১০ জন ব্যবহার করলেন। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যেও ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে সেই একই হেলমেট থেকেই। এক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ছাড়াও অ্যালার্জিজনিত বিভিন্ন রোগের ভাইরাসের সংক্রমণও হতে পারে। এছাড়াও খুশকি ছড়াতে পারে, ময়লা জমতে পারে, এমনকি অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াও জন্ম নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সার্জিক্যাল মাস্ক ক্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে সাময়িকভাবে। কিন্তু সেটিও সবসময়ে ব্যবহার করা কতটুকু বাস্তবসম্মত, সেটাও ভাবতে হবে। কারণ এটিও কিন্তু একবার ব্যবহারের পরই অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এদিকে, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসসহ ভাড়ায় চালিত বিভিন্ন মোটরসাইকেলে যে হেলমেট ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনে একই হেলমেট একাধিক ব্যক্তির ব্যবহারে বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে আমরা আগেই শঙ্কার কথা জানিয়েছিলাম। এক্ষেত্রে ধরনের কোনো গণপরিবহনের জন্য কী বার্তা হবে, সেটা আমাদের সচেতনতার মধ্যে অর্ন্তভুক্ত করে নেব এবং বিষয়টি সচেতনতামূলক বার্তা হিসেবে আমরা প্রচার করব। তবে এভাবে একজনের হেলমেট আরেকজনের ব্যবহার করার বিষয়টি স্বাস্থ্যকর নয়।