Sunday 08 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হোম কোয়ারেনটাইন আর চিকিৎসা ঝুঁকি নিয়ে বেহাল চট্টগ্রাম


২২ মার্চ ২০২০ ২১:৫৮ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২০ ২০:০০
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেনটাইনে রাখা এবং চিকিৎসকের পারসোনাল প্রটেকশন ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) ছাড়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া নিয়ে বেহাল অবস্থায় আছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। সচেতনতার তাগিদ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়েও বিদেশ ফেরত অনেককেই হোম কোয়ারেনটাইনে রাখা যাচ্ছে না। আর পিপিই ছাড়া সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে গিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স ও রোগীর সেবায় জড়িত অন্যান্যদের। পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতাল ছাড়ছেন সাধারণ রোগীরা। বিভিন্ন হাসপাতালে সর্দি-কাশি নিয়ে আসা রোগীদের চিকিৎসা বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া বন্দরনগরীতে আর কোনো সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই। এর ফলে করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হলে আইসিইউ শয্যা নিয়েও চট্টগ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগকে বিপাকে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি মিয়া সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের অবতরণ বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত শনিবার (২১ মার্চ) রাতে ১১৬ জন মধ্যপ্রাচ্য থেকে চট্টগ্রামে এসেছেন। তাদের হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার পরামর্শ দিয়ে বিমাবন্দর ত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়। বিমানবন্দর দিয়ে আসা ৯৭৩ জন এ পর্যন্ত হোম কোয়ারেনটাইনে আছেন।

তবে বিভিন্ন স্থলবন্দর এবং অন্যান্য বিমানবন্দর দিয়ে দেশে ঢুকে চট্টগ্রামে আসা বিদেশ ফেরত হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার উপেযোগী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার শর্ত ভঙ্গ করায় গত বুধবার (১৮ মার্চ) থেকে অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসন। এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার হাটহাজারী, মীরসরাই, পটিয়া, বোয়ালখালী, লোহাগাড়া, ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন উপজেলায় কমপক্ষে ১০০ জনকে জরিমানা করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কামাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘হোম কোয়ারেনটাইনের শর্ত প্রতিপালনের অঙ্গীকার করে বাড়ি গেলেও অনেকে সেই শর্ত মানছেন না। তাদের জোর করে মানাতে হচ্ছে। যখনই আমাদের নজরে আসছে, প্রমাণ হচ্ছে, আমরা জরিমানা করছি। অথচ এদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষিত, সচেতন ব্যক্তি। মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও যারা নিয়ম মানছেন না, তাদের শাস্তি দিয়ে নিয়ম মানতে বাধ্য করা আসলেই কষ্টকর। আমরা উপজেলায় ও ইউনিয়নে জনপ্রতিনিধিদের বলেছি, নিজ নিজ এলাকায় হোম কোয়ারেনটাইনের বিষয়টি নজরে রাখতে।’

হোম কোয়ারেনটাইন নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুরুর দিকে হোম কোয়ারেনটাইনের বিষয়টিকে বিদেশ ফেরতদের অধিকাংশই পাত্তাই দেননি। তারা বিদেশ থেকে এসে আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন, কেউ কেউ মসজিদ-মন্দিরে গেছেন। অনেকে চট্টগ্রামে বাইরের বিমানবন্দরে নেমে সড়কপথে চট্টগ্রামে এসে বিদেশ থেকে আসার বিষয়টি গোপন করেছেন। এমনকি হোম কোয়ারেনটাইনে থাকা অবস্থায় বিয়ের আয়োজনও করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ধারাবাহিক অভিযানের পর এই চিত্র কিছুটা পাল্টেছে।’

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন বিভাগের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সারোয়ার ই জামান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, শনিবার রাত ১২টায় শাহ আমানত বিমানবন্দর সব ধরনের আন্তর্জাতিক বিমানের অবতরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর রোববার কোনো আন্তর্জাতিক বিমান অবতরণ করেনি। এর ফলে রোববার সারাদিনে বিদেশ ফেরত কেউ চট্টগ্রামে ঢুকতে পারেননি।

সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানবন্দর, স্থলবন্দর দিয়ে বিদেশি কিংবা বিদেশফেরত বাংলাদেশি ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

রোগীদের দূর থেকে চিকিৎসা দিচ্ছেন ডাক্তাররা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও সেবা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। বিশেষত পিপিই ছাড়া রোগীদের সেবা দেওয়াকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি ও বর্হিবিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, চিকিৎসকদের কক্ষের দরোজার সামনে একটি খালি শয্যা দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে, যেন ভেতরে কেউ ঢুকতে না পারেন। এরপর কক্ষের বাইরে আরেকটি শয্যায় রোগীকে বসিয়ে বা শুইয়ে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা বা উপসর্গ শুনে পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসক। এক্ষেত্রে হ্যান্ডমাইকও ব্যবহার করতে দেখা গেছে চিকিৎসকদের। যেকোনো রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রেই এভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

চমেক হাসপাতালের বর্হিবিভাগে দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার ফয়সাল কবির বলেন, ‘আমি ডাক্তার। আমাকে তো চিকিৎসা দিতেই হবে। পিপিইটা পেলে ভালো হতো। যেহেতু পাইনি, আমার ব্যক্তিগত সচেতনতা তো প্রয়োজন। কারণ আমি শুধু আক্রান্ত হব এমন নয়, আমি যেসব রোগী দেখব তারাও তো আক্রান্ত হতে পারেন। সুতরাং সচেতনতা ছাড়া তো আমার কাছে আর বিকল্প কিছু নেই।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর ও জরুরি বিভাগে দৈনিক গড়ে একহাজারের বেশি রোগী আসেন। ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমানে রোগীর সংখ্যা আরও বেড়েছে। তবে ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমছে।

সূত্রমতে, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সাধারণ সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীকে কোনো ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না। সেখানে বহির্বিভাগে কিছু নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্তকে চিকিৎসা দেওয়া ছাড়া ওয়ার্ডে কার্যত সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। করোনায় আক্রান্তদের আইসোলেশনের জন্য এরই মধ্যে জেনারেল হাসপাতালের ১০০ শয্যা প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেনারেল হাসপাতাল ছাড়া নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতেও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের কোনো ধরনের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে না।

চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি ১০টি বড় হাসপাতালের পাশাপাশি ক্লিনিক আছে অন্তত পাঁচশ।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে পিপিই’র কোনো প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা লাগবে। আমাদের কাছে কিছু পিপিই আছে। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। এরপরও দুয়েকদিনের মধ্যে আমরা কিছু পিপিই সরকারি হাসপাতালে দেবো।’

আইসিইউ নিয়ে দুশ্চিন্তায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউ শয্যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেন চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া সরকারি পর্যায়ে বন্দরনগরীর আর কোনো সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এরই মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে আইসোলেশন বেড করা হয়েছে। কিন্তু জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডিতে কোনো আইসিইউ নেই। চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে অন্যান্য রোগীরাও থাকেন। সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী রাখা যাবে না।

সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা শ্বাসকষ্টে ভোগেন বেশি। এজন্য তাদের জন্য আইসিইউ বেশি প্রয়োজন। আমরা ১০টি আইসিইউ শয্যা মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছি।’

করোনা শনাক্তকরণ কিট আসেনি

চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকা থেকে কিট পাঠানোর কথা থাকলেও রোববার পর্যন্ত সেগুলো আসেনি। কিট আসার কথা ফৌজদারহাটে বিআইটিআইডিতে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের একজন চিকিৎসক ও দু’জন টেকনোলজিস্টকে প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তারা প্রশিক্ষণ শেষে কিট নিয়ে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিআইটিআইডি’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোমবার কিট নিয়ে চট্টগ্রামে আসবেন প্রশিক্ষণরতরা। প্রাথমিকভাবে ১৫০ থেকে ২০০ কিট পাঠানো হচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন।

সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আশা করছি সোমবার কিট পাব। যদিও এটি আমাদের বিভাগের বিষয় নয়। কিট পাওয়ার পরও যে সবার নমুনা পরীক্ষা করা হবে, এমন নয়। সিলেক্টিভ কিছু ক্ষেত্রে নমনুা পরীক্ষা করা হবে।’

করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ চট্টগ্রাম পিপিপি স্বাস্থ্য ঝুঁকি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর