Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বিধিও যাদের কান্না শোনে না…’


২১ এপ্রিল ২০২০ ১৬:১৪

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম শহরে পথ চলতে গিয়ে দেখা মেলে তাদের। মাথার ওপর ছাদ হয়ে আছে ‍সুবিশাল আকাশ, প্রখর রোদ কিংবা ঝড় জল বৃষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী। ইট-পাথরে গড়া শক্ত ফুটপাত তাদের জন্য বিছানা। শহরবাসীর ফেলে দেওয়া উচ্ছিস্ট ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে যাদের দিনান্তে আহার জোটে, তাদের এই কথিত সভ্য সমাজ মানুষ বলে না।

শিল্পী আব্দুল জব্বারের কালজয়ী গানের ভাষায় ‘বিধিও যাদের কান্না শোনে না’। করোনাকালে সত্যিই তাদের কান্না শোনার যেন কেউ নেই ! চলছে ‘লকডাউন’। শহরবাসী ঘরবন্দি। হোটেল-রেঁস্তোরা বন্ধ। ডাস্টবিনে আগের মতো খাবারের উচ্ছিস্ট পড়ে থাকে না। ভিক্ষুকের থালা খালি পড়ে থাকে। নিজেকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টার মাঝে তাদের অনাহারে থাকার কান্নার শব্দ ম্রিয়মাণ।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম শহরে ছড়িয়ে থাকা হাজারো অনাহারি মানুষের কান্নার শব্দ পৌঁছেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার একদল তরুণের কাছে। তাদের মধ্যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ করপোরেট অফিসের কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-তাদের মাথায় ছায়া হয়ে আছেন একদল মুক্তিযোদ্ধাও। শহরে ঘুরে ঘুরে ক্ষুধার্ত ভাসমান মানুষগুলোর কাছে একবেলা রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন তারা। মো. আব্দুল জব্বারের সেই কালজয়ী সেই গানের ভাষায়, ‘ তোমার যাদের মানুষ বলো না, বিধিও যাদের কান্না শোনে না/ তারাও মানুষ কাঁদে তাদের প্রাণ/ আমি চোখের জলে শোনাই তাদের গান।’

মানুষের বদলে শহরবাসী যাদের দিয়েছে ভিখারি, পাগল, নেশাখোর‘- এ ধরনের নানা নাম, ক্ষুধার পেটে ভাত পেয়ে তাদের অনেকের চোখেও সত্যিই ঝরছে পানি- বলেছেন তাদের নিয়ে কাজ করা তরুণেরা।

করোনাকালে শহরজুড়ে ত্রাণ বিতরণ চলছে। গরীব-নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, অনেকেই পাচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেওয়া ত্রাণ। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরে দিনদিন বাড়তে থাকা এমন অনাহারি মানুষগুলো যেন ছিল সবার নজরের বাইরে! তাদের জন্য অন্তঃত একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করার চিন্তা মাথায় আসে এই শহরেরই চার তরুণের।

বিজ্ঞাপন

এদের মধ্যে আছেন- ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সরওয়ার আলম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক রাসেল, করপোরেট অফিসের কর্মকতা এস এম ইউসুফ সোহেল এবং ব্যবসায়ী সাহেদ মুরাদ। সবাই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। পরে তাদের পরিচালিত একটি সামাজিক সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশান অন হিউম্যান ওপেনিয়নের (ইকো) ব্যানারে এই কর্মসূচি তারা শুরু করে দেন।

সংগঠনের সভাপতি মোহাম্মদ সরওয়ার আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিজেরাই টাকা দিয়ে ফান্ড করি। পহেলা বৈশাখ থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ শুরু করি। কয়েকদিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। উনারাও টাকাপয়সা দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ফেলো সোসাইটি, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েকজন মানবিক মানুষও আমাদের সহযোগিতা দিয়েছেন। প্রতিদিন দুপুরে আমরা নগরীর বিভিন্ন স্পটে যেখানে ভিক্ষুক-ভাসমান মানুষেরা থাকেন, সেখানে খাবার নিয়ে যাই।’

মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) দুপুরে নগরীর লালখান বাজার, জুবিলি রোড, নিউমার্কেট, কোতোয়ালি মোড়, জেলা পরিষদের সামনে, লালদিঘীর পাড়, আন্দরকিল্লা, মোমিন রোড, গণি বেকারি, চট্টগ্রাম কলেজ এলাকায় রান্না করা খাবার বিতরণ করেন তারা।

নগরীর গণি বেকারির মোড়ে ফুটপাতে শুয়ে আছেন প্রায় ৪৫ বছর বয়সী মোবারক আলী, দুই পা নেই। অনাহারক্লিষ্ট শরীরে কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। খাবারের প্যাকেট দেখে হাত বাড়িয়ে দেন। পরম মমতায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে খাবার তুলে দেন এস এম ইউসুফ সোহেল।

নগরীর চকবাজার এলাকায় জন্মান্ধ মনসুর আলী (৫৫) ভিক্ষার আশায় বসে আছেন মেয়েকে নিয়ে। জানালেন, দুজনেই গতকাল (সোমবার) দুপুর থেকে অভুক্ত। তাদের হাতে দেওয়া হয় দুটি খাবারের প্যাকেট। দেরি করেননি, গোগ্রাসে গিলেছেন ক্ষুধার্ত বাবা-মেয়ে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ভিক্ষা করেন ষাটোর্ধ্ব নুরুন্নেছা। খাবার পেয়ে তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে মানুষ নাই। ভিক্ষা দেওয়ারও কেউ নাই। খয়রাত পাই না। একবেলার খাবার যারা দিচ্ছেন, তাদের দোয়া করছি।’

সংগঠনের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ইউসুফ সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনাহারি মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি, এটা আমাদের কাছে অনেক আনন্দের। ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে যখন খেতে দেখি, অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু এর চেয়েও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনেক অনাহারি মানুষের মুখে আমরা খাবার তুলে দিতে পারছি না। রাস্তায়-ফুটপাতে থাকা মানুষগুলোর বাইরেও অনেক দিনমজুর, গরীব অসহায় মানুষ আছেন। তাদের অনেকেই অনাহারে-অর্ধাহারে আছেন। আমরা যখন ভিক্ষুকদের জন্য খাবার নিয়ে যাই, তাদের অনেকেও এসে দাঁড়ান খাবারের আশায়। কিন্তু আমাদের সাধ্য সীমিত।’

গত আটদিনে নগরীর কমপক্ষে ৫০টি স্পটে প্রায় দুই হাজার মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন এই চার তরুণ। বিভিন্নসময় তাদের সঙ্গে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক ড. গাজী সালেহউদ্দিন, সাবেক ছাত্রনেতা সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস।

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘রান্না করা খাবারের মধ্যে আমরা দিচ্ছি- খিচুড়ির সঙ্গে ডিম অথবা আলু-মুরগি। প্রতিদিন আমাদের একজন সদস্যের বাসায় কমপক্ষে ৩০০ জনের জন্য রান্না হচ্ছে। দুপুর একটার আগেই সেই খাবার আলাদা-আলাদা প্যাকেটে করে আমরা পৌঁছে যাচ্ছি বিভিন্ন স্পটে।’

ইকো’র সম্পাদকদণ্ডলীর সদস্য সাহেদ মুরাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত করোনার প্রভাব থাকবে, একেবারে হতদরিদ্র, গৃহহীন, ভাসমান মানুষ যতদিন পর্যন্ত এই দূরবস্থায় থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখার চিন্তা আমাদের আছে। তবে আমাদের সাধ্য সীমিত। এই শহরে অনেক বিত্তবান মানুষ আছেন। পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার অনাহারী মানুষকে বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব। সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

করোনা লক ডাউন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর