যানহীন নদীতে ফিরছে সবুজ প্রাণ
২৪ এপ্রিল ২০২০ ০৮:১৫
ঢাকা: নেই কোনো যন্ত্রযান। নেই কোনো সাড়াশব্দ। বিকট শব্দে চলছে না বিশালকৃতির কোনো জলদানব। পানিতে নেই বৈঠার আঘাত। বাতাসে নেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ব্যস্ত রাজধানীর কোলাহলও গিয়ে মেশেনি ঘাটে। যেন শীতলভাবে বইছে শীতলক্ষ্যা। আর বুড়িগঙ্গায় নেই কোনো বুড়ির চেঁচামেচি। ঢাকার চারপাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর এমন দৃশ্য হয়তো কেউ দেখেনি অনেককাল।
মহামারি করোনায় যখন বিপর্যস্ত পৃথিবীর মানুষ, জীবন বাঁচাতে মানুষ যখন আশ্রয় নিয়েছে নিজ গৃহে; প্রকৃতি তখন যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। এমনিতেই রাস্তায় গণপরিবহন নেই বলেই বাতাসও যেন সজীবতায় ফিরেছে। তারওপর নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় বদলে গেছে নদীর চিত্র। একটু একটু করে বদলাচ্ছে নদীর পানি। নেই দুর্গন্ধ, ময়লা-আবর্জনা। আর কিছুদিন গেলে হয়তো নদীর ভেতরটাও দেখা যাবে। তবে এই সুযোগে প্রাণ-প্রকৃতিও বেড়ে উঠছে নদীর জলে। স্বচ্চ পানিতে ভাসছে কচুরিপনা। এ যেন সবুজের সমারহ; এ যেন সেই শত বছর আগের পুরানো নদী।
বুড়িগঙ্গার খেয়াঘাটের মাঝি ইকবাল হোসেন জানান, করোনার কারণে সব নৌযান বন্ধ রয়েছে। ঢাকায় অনেক কারখান বন্ধ। আগে এসব কারখানা থেকে ময়লা পানি নদীতে আসতো। এখন তা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে নদীর পানিতে তেমন গন্ধও নাই। পানিও বেশ পরিষ্কার। তবে সুয়ারেজ লাইনগুলো না থাকলে পানি একেবারেই গন্ধমুক্ত হয়ে যেত।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকার বাসিন্দা জয়ন্ত সাহা বলেন, ‘প্রতিদিন বিভিন্ন ঘাট থেকে হাজার হাজার বার ট্রলার, নৌকার যাতায়াতে এই নদী থাকতো কোলাহলপূর্ণ। এমনকি পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা কখনোই নদীর এই শান্ত পরিবেশ দেখিনি। নদীর পাড়ে সবুজে ঘেরা পরিবেশ আর তুলনামূলক বিশুদ্ধ বাতাস ছুটির দিনে মানুষের দেহ আর মনকে চাঙ্গা রাখার ওষুধ হিসেবে কাজ করতো। যে কারণে ছুটির সময় নদীতে আরও বেশি লোকের সমাগম হতো। নদীতে চলতো শত শত বালুবাহী বাল্কহেড, মালবাহী স্টিমার ও ছোট-বড় অসংখ্য লঞ্চ।’
জয়ন্ত সাহা বলতে থাকেন, ‘আজ এই নদী বড়ই শান্ত। সবকিছুর মতো এই নদীও যেন কেমন স্থবির হয়ে গেছে। নদীর এই রূপ আগে কখনও দেখিনি। আমার কাছে আজ বড়ই অপরিচিত এই নদী। খুব ছোটবেলায় যেমন বাঁশের ভেলা চলতে দেখেছি, ঠিক এখন আবার কচুরিপানার স্রোত দেখছি। একদিকে করোনার স্থবিরতা যেমন দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দিচ্ছে, ঠিক তেমনি নদীর এই পুরোনো রূপ দেখে মনে কিছুটা স্বস্তিও ফিরছে। অদ্ভুত অনুভূতি।’
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মো. আলিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ থাকায় আজ নদীর এই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে- এটি যেমন সত্য, তেমনি সবকিছু চালু রেখেও নদীর এই রূপ ধরে রাখা যাবে। আমরা সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখেছি, সেখানে তো অনেক কলকারখানা রয়েছে। কিন্তু তারা কলকারখানাগুলোর বর্জ্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফেলে নদীর প্রকৃতিও ঠিক রেখেছেন। নদীর প্রকৃতি হারায় আমাদের অসচেতনতার কারণে। যত্রতত্র নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা, কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধিত না করে সরাসরি নদীতে ফেলা।’ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে সচেতনতা এবং সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় নদীর পরিবেশ সুন্দর রাখা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নির্বাহী সহ-সভাপতি মো. আব্দুল মতিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধুমাত্র বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা নয়, দেশের সব নদীতেই প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফিরে এসেছে ডলফিন। বিভিন্ন শহরে পশুপাখিরা নেমে এসেছে। আকাশ ঘন নীল। সবকিছুই সুন্দর। কিন্তু মানুষও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। মানুষকে বাদ দিয়ে পরিবেশ সম্পূর্ণতা পায় না। মানুষতো সব সময় এমন বদ্ধ ঘরে থাকবে না। জীবিকার জন্য মানুষকে বের হতেই হবে। মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রেখেও যদি নদীর চিত্রটা এমনটা রাখে তবেই হবে সুন্দর পরিবেশ।
তবে করোনা পরিস্থিতি আমাদেরকে দেখিয়ে দিল যে, যা আমরা বার বার বলে আসছি- মানুষ সচেতন হলেই পরিবেশ সুন্দর হবে। এর থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কয়লা-বিদ্যুৎ করা যাবে না, গাছকাটা যাবে না, নদীতে অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা যাবে না। এসব বিষয় নিয়ে যদি আমরা সচেতন হই, আমাদের রাজনৈতিক নেতাসহ জ্ঞানীদের যদি বোধ উদয় হয়, তাহলেই পরিবেশ সুন্দর হয়ে উঠবে। পরিবেশকে রক্ষা করেই বাঁচতে হবে মানুষকে। পরিবেশের বাঁচা মানেই মানুষের বাঁচা।