ভার্চুয়াল কোর্টের পক্ষে তরুণরা, সময়সাপেক্ষ বলছেন প্রবীণরা
৫ মে ২০২০ ০৯:৫৭
ঢাকা: মহামারি করোনাভাইরাসের কারনে স্তব্ধ গোটা পৃথিবী। বাংলাদেশেও চলছে সাধারণ ছুটি। অন্য সব অফিসের মতো বন্ধ রয়েছে সব আদালতও। দীর্ঘ দিন ধরে সব আদালত বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানির অপেক্ষায় থাকা বিচারপ্রার্থীরা।
মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও জরুরি বিষয় নিষ্পত্তির জন্য করোনাকালে অন্তত একটি করে হলেও ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’ খোলার পক্ষে মত দিচ্ছেন তরুণ আইনজীবীরা। তারা বলছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে ভার্চুয়াল কোর্ট না থাকায় ডিজিটাল প্রযুক্তিকে উপেক্ষা করার সমতুল্য।
তবে প্রবীণ আইনজীবীরা মনে করছেন, ভার্চুয়াল কোর্ট চালু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কেননা ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনার জন্য বিচারক, আইনজীবী, কোর্টের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এখন সবাই ঘরে অবস্থান করছেন বলে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণেরও সুযোগ নেই বলেই মনে করছেন তারা।
এর আগে, করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করতে ফুল কোর্ট সভা সিদ্ধান্ত নিলেও তার কোনো অগ্রগতি জানাতে পারছেন না সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা।
ভার্চুয়াল কোর্টের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সারাবাংলাকে বলেন, হঠাৎ করেই ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করা যাবে না। আমাদের সে ধরনের সামগ্রিক ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ভার্চুয়াল কোর্ট সম্পর্কে অভিজ্ঞতাও তো অর্জন করতে হবে।
তিনি বলেন, ভার্চুয়াল কোর্টে একজন বিচারক থাকবেন, তার সঙ্গে অন্য স্টাফরাও থাকবেন। তাই এটা চালু করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মত অ্যাটর্নি জেনারেলের।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে ভার্চুয়াল কোর্টের কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই। বিচার ব্যবস্থায় এ পদ্ধতি সংযুক্ত করতে হবে। দেশের এই মহামারি প্রাদুর্ভাবের সময় এটা চালু করা কতটা জরুরি, সেটা গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।
ভার্চুয়াল কোর্ট কিভাবে চলবে, কোন কোন মামলা শুনানি হবে, আসামিরা কীভাবে হাজির হবেন, সপ্তাহে কত দিন চলবে— এসব বিষয় আগে নির্ধারণ করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ভার্চুয়াল কোর্ট গঠনের উদ্যোগ অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে এটা চালু করা আমাদের জন্য কঠিন ব্যাপার। রাতারাতি চালু করা যাবে না। কারণ, আইটি বিশেষজ্ঞসহ সহায়ক অন্যান্য দক্ষ জনবল দরকার। স্বল্প পরিসরে ভারতে ও সিঙ্গাপুরে এ ধরনের কোর্ট চালু রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা চালু করার ক্ষেত্রে মানুষের জীবনে ঝুঁকিও রয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বল্প পরিসরে খোলার বিষয়ে মতপ্রকাশ করেন এই আইনজীবী।
তবে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিনের অবস্থান ভার্চুয়াল কোর্ট খোলার পক্ষে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল কোর্ট অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ। তবে সাধারণ আইনজীবীদেরকে যেন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয় এবং তারা যেন এটা ব্যবহার করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে বিচারপ্রার্থীরা লাভবান হবেন। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের পাশাপাশি নিম্ন আদালতও এই অনলাইন বিচার ব্যবস্থার আওতায় আনার পক্ষে মত দেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির বক্তব্যের সঙ্গে একমত তরুণ আইনজীবীদের প্রায় সবাই।
তাদের একজন ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে আদালত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকলে বিচার কাজে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। বর্তমান বাস্তবতায় ভার্চুয়াল (অনলাইন) কোর্ট কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবে, এই পদ্ধতিতে সব আইনজীবীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা হবে খুবই চ্যালেঞ্জের কাজ। তবুও জনগুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো শুনানির জন্য হলেও ভার্চুয়াল কোর্ট চালু বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।
আরেক আইনজীবী হুমায়ুন কবির পল্লব বলেন, বিশেষ করে করোনার মতো পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের মৌলিক মানবাধিকার ও মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি পথ হলেও চালু রাখা দরকার। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি যদি আবারও তৈরি হয়, তাহলেও কিন্তু এখনই সময় এটা প্রস্তুতি নেওয়ার।
অ্যাডভোকেট দিদারুল আলম দিদার বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে চলমান ক্রান্তিকালে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু হতে পারে। এরকম দৃষ্টান্ত কিন্তু বেশকিছু দেশে বিদ্যমান। তাই করোনাভাইরাসজনিত সংক্রমণ প্রতিরোধে আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের শারীরিক উপস্থিতি এড়াতে এখন এ ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছি না। কেননা অনেক বিচারপ্রার্থী করোনার কারণে আদালত বন্ধ থাকায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘সংবিধানে দেশের নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই স্বল্প পরিসরে হলেও কোর্ট খোলা রাখা জরুরি। তবে করোনা পরিস্থিতিকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। সেজন্য করোনার এই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে এক বা একাধিক ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা হওয়া দরকার।’
তিনি আরও বলেন, সাধারণ ছুটি চললেও অপরাধ কিন্তু থেমে নেই। তাই ভুক্তভোগীরা যেন প্রতিকার পান, সেই সুযোটি সবসময়ের জন্য উন্মুক্ত রাখা দরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু সময়ের দাবি বলেও মন্তব্য তার।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ফুল কোর্ট সভায় ভার্চুয়াল কোর্ট খোলার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ কর্মকর্তা সাইফুর রহমান বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো আপডেট নেই। যদি কোনো অগ্রগতি হয়, আপনাদের জানাব।’
ভার্চুয়াল কোর্ট কী
সশরীরে আদালতে উপস্থিত না হয়ে যার যার জায়গা থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচার পরিচালনা করাই হচ্ছে ভার্চুয়াল কোর্ট। বাংলাদেশে বিষয়টি নতুন হলেও, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এখন ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচারিক কাজ চলছে।
করোনা অফিস-আদালত সব বন্ধ হয়ে গেলে কিছু আইনজীবী স্বল্প পরিসরে কিংবা ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে কোর্ট খুলতে প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখেছিলেন। তারই আলোকে গত ২৩ এপ্রিল সীমিত পরিসরে আদালত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। তবে করোনা পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নেওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট বারসহ আইনজীবীদের বড় একটি অংশের কঠোর আপত্তিতে সে সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়।
পরে গত ২৬ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভায় হাইকোর্ট রুলস সংশোধন করে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ জারির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় ওই ফুল কোর্ট সভায়। পাশাপাশি বিচারক ও আইনজীবীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার বিষয়টিও উঠে আসে ফুল কোর্ট সভায়।