১৮ দিনেও মেলেনি করোনা পরীক্ষার ফল, ভর্তি নিচ্ছে না হাসপাতালও
২১ মে ২০২০ ২০:১৮
ঢাকা: গণমাধ্যমকর্মী ইমন চৌধুরী (ছদ্মনাম)। ৩ মে পর্যন্ত টানা ৯ দিন জ্বরে ভুগছিলেন। ১ মে তার স্ত্রী ও সাড়ে তিন বছরের বাচ্চারও জ্বর আসে। তাদের সবার করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) উপসর্গ থাকায় নমুনা সংগ্রহের জন্য ২ মে হটলাইনে যোগাযোগ করেন। ৩ মে বিকেলে নমুনা সংগ্রহ করতে আসেন দুজন।
নমুনা সংগ্রহের পর বারকোড নম্বরযুক্ত একটি কাগজ দেওয়া হয় তাদের। একই সঙ্গে ইমন চৌধুরীর ই-মেইল আইডি ও মোবাইল নম্বর নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ২১ মে পর্যন্ত ই-মেইল বা মোবাইল নম্বরে নমুনা পরীক্ষার কোনো ফলাফল আসেনি ইমন চৌধুরীর কাছে।
হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া বা অন্যান্য পরীক্ষার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলেও উপসর্গ শুনে তারা জানায় নমুনা পরীক্ষার ফলাফল না পেলে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না।
প্রায় একই অবস্থা পুরান ঢাকা নিবাসী সোহেল চৌধুরীরও (ছদ্মনাম)। জ্বর, কাঁশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বেশ কিছুদিন ভোগার পরে ১০ মে মিটফোর্ড হাসপাতাল বলে পরিচিত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে নমুনা পরীক্ষা করান তিনি। তবে ২১ মে পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার কোনো ফলাফল জানতে পারেননি তিনিও। প্রতিদিনই মোবাইল ও ই-মেইলে চেক করলেও সেখানে নমুনা পরীক্ষার কোনো ফলাফল এখনো জানানো হয়নি তাকে।
জ্বর কমে গেলেও কাশি এখনো কমেনি। কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা ফলাফল না পাওয়ার কারণে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার পরে কয়েকদিন অপেক্ষা করি। এরপরে মিটফোর্ড হাসপাতালের বহির্বিভাগে টিকেট কেটে আমি নমুনা পরীক্ষা করাই পরের দিন। সেদিন আমাকে বলা হয় যদি আমার নমুনা পরীক্ষার ফল পজেটিভ হয় তবে জানিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু নেগেটিভ হলে সেটা জানাতে দেরি হতে পারে। কিন্তু এখনও পরীক্ষার ফলাফল আমাকে জানানো হয়নি। এদিকে একটি হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায় নমুনা পরীক্ষার ফল সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।’
সেলিম ইসলাম (ছদ্মনাম) একজন সরকারি কর্মচারী। প্রায় ১৬ দিন হয়ে গেলেও এখনো নমুনা পরীক্ষার ফলাফল তিনি হাতে পাননি। তবে এর বেশি কিছু বিস্তারিত জানাতে চাননি।
শ্বাসকষ্ট ও পাতলা পায়খানাসহ কোভিড-১৯ এর উপসর্গ নিয়ে গুরুতর অসুস্থ মিরপুরের রাহাত ইসলামের পরিবারের সবার নমুনা পরীক্ষা করা হয় ১৫ মে। সেদিন থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করা হলেও সেটা সম্ভব হয়নি নমুনা পরীক্ষার ফলাফল না থাকায়। আর তাই বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা চালানোর চেষ্টা করে পরিবার। ১৭ মে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। আর সে জন্য অপেক্ষা করে পরিবার। তবে সেদিন নমুনা পরীক্ষার ফল জানতে পারেননি।
১৭ মে রাতেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে জানানো হয় নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া ভর্তি সম্ভব না। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করেন তার পরিবার সদস্যরা। সেখান থেকে জানানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু অবস্থা আরও বেশি খারাপ হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা সময় বিবেচনা করে তাকে নিয়ে যান মিরপুরের ১২ নম্বরে অবস্থিত রিজেন্ট হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে কোভিড-১৯ রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসা দেওয়া হবে কিনা তা পরিবারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। প্রথমে পরিবার সাহস না করলেও শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে রাজি হয়। ১৮ মে একজন গণমাধ্যমকর্মীর সাহায্য নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে যোগাযোগ করা হলে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়। পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে।
রাহাত ইসলামের সহধর্মিনী প্রশ্ন করে বলেন, ‘এই সময়ে যদি কোনোভাবে আমার স্বামীর কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়ে থাকে তবে তার জন্য আমি কাকে দায়ী করব?’
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার নমুনা পরীক্ষা ফলাফল দেখানোর পরে ভর্তি করানো যায়।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ল্যাবের দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক ডা. তারেক মাহবুব খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা সাধারণত যে দিন নমুনা সংগ্রহ করি তার পরের দিনই ফলাফল পাঠিয়ে দেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারে (এমআইএস)। সেখান থেকে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হয়।’
এক্ষেত্রে ১০ তারিখ নমুনা পরীক্ষা করা হলেও এখনো ফলাফল পায়নি এমন অবস্থার কারণ কী হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. তারেক মাহবুব বলেন, আমরা যেসব পরীক্ষার ফলাফল পজেটিভ বা নেগেটিভ পাই সেগুলো যেমন এমআইএসে পাঠাই। কিছুক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল প্রথমবারেই পজেটিভ বা নেগেটিভ এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এক্ষেত্রে কিছু নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ইনকক্লুসিভ বা ইনভ্যালিড অবস্থায় থাকে। সেক্ষেত্রেও আমরা সেটা এমআইএসে জানিয়ে দেই। তখন এমআইএস থেকে আবার যার থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয় তার সঙ্গে যোগাযোগ করে হয়ে থাকতে পারে।
তবে সোহেল চৌধুরী জানান তার সঙ্গে এমন কেউ যোগাযোগ করেননি।
এ বিষয়ে বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষে নমুনা সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক (এমআইএসস) সমীর কান্তি সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা নমুনা পরীক্ষা খুব দ্রুতই করে ফেলেছি। কিন্তু সেই পরীক্ষার ফলাফল সফটওয়ারে এন্ট্রি দিতে হয়। তারপরেই সাধারণত মেইলে ও মোবাইলে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই এসএমএস বা মেইল যাওয়ার জন্য কাউকে ডাটা এন্ট্রি দিতে হয়। আমাদের ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের খুবই শর্টেজ। যে হারে আমাদের কাজ হয় তাতে একেকটা সেন্টারে দুই থেকে তিনজন করে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর থাকা উচিত। সে জায়গায় আমরা একজনও দিতে পারিনি। আমাদের যারা ডাটা এন্ট্রি দেয় সেখানেও যথাযথ জনবল নেই।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে হলেও তিনি ফোন ধরেননি।